প্রত্যেকেই তার নিজের মাধ্যমটিকে ভালোবাসে। সে চায় তার নিজের অনুভূতি, অভিজ্ঞতাকে নিজের সে–মাধ্যমে উপস্থাপন করতে। আর এটা যদি হয় নিজের জীবন থেকে সেঁচা তবে সেটা ব্যতিক্রমধর্মী এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে বৈকি।
তেমনই একটা অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির প্রকাশ আমরা দেখলাম সম্প্রতি। মাশরুর পারভেজ পরিচালিত প্রায় দু’ঘন্টার কাহিনীচিত্র ‘গোয়িং হোম’এ। মাশরুর একজন তরুণ নির্মাতা। এ–ছবির আগে ‘রাইয়ান’ নামে তাঁর প্রথম কাহিনীচিত্রটি তিনি নির্মাণ করেছেন ২০১৭ সালে। গোয়িং হোমের কেন্দ্রীয় চরিত্রও–রাইয়ান। এটি রাইয়ানের সিকুয়েল না হলেও একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। রাইয়ানকে নিয়ে আরও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা পরিচালক জানালেন। সেটা তৈরি হলে একটা ট্রিলজি সিনেমার স্বাদ আমরা পাবো।
মাশরুরের একটি চলচ্চিত্রিক পরম্পরা ও উত্তরাধিকার রয়েছে। তাঁর বাবা চাচারা সকলেই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বাবা চিত্রপ্রযোজক ও পরিচালক মাসুদ পারভেজ, যিনি অভিনেতা সোহেল রানা হিসেবেই অত্যধিক পরিচিত ও জনপ্রিয়। তাঁর অভিনয় আঙ্গিক তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ছিল। আন্ডারটোনাল অভিনয় যা আমাদের সিনেমায় প্রায় নেই বললেই চলে, সোহেল রানা সেই ধারার অভিনয়ে এদেশের আপামর দর্শককে দীর্ঘদিন আনন্দ দিয়ে গেছেন। এদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি ‘ওরা ১১ জন’– এর প্রযোজক ছিলেন তিনি। পরে ‘মাসুদ রানা’ ছবিটির মাধ্যমে তিনি পরিচালনা ও অভিনয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রী জিনাত বেগম চিকিৎসক। স্বভাবতই মাশরুর শৈশব থেকেই বাবা ও মায়ের দুই ধরনের পেশাগত আবহের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। আত্মপ্রকাশ করেছেন বাবার অনুসারী হয়ে। মাশরুরের অভিনয়েও বাবার স্কুলিংটা লক্ষণীয়। তাঁর অভিনয় যথেষ্ট স্বাভাবিক। রাইয়ান তাঁর ডাকনাম। তাঁর তৈরি ছবি দুটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামও তাই এবং এ–চরিত্রের অভিনেতাও তিনি। গোয়িং হোম ছবির পুরো শরীর জুড়ে এক ধরনের দমিত–অবদমিত মনস্তত্বের দোলাচল আমরা দেখি। এটা হয়তো পরিচালকের মায়ের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে জারিত। এই মনস্তাত্বিক পরিবেশের সৃষ্টিটা যথেষ্ট পরিপক্ক মনে হয়েছে যা এ বয়সের একজন পরিচালকের কাছে রীতিমত কঠিন। ছবির চিত্রনাট্যও মাশরুরের লেখা। ছবি দেখে বোঝা যায় পোস্ট প্রোডাকশনের মতো প্রি প্রোডাকশনেও অনেক সময় নিয়েছেন তিনি যা ভালো লক্ষণ।
মাশরুরের কথায়, তার ছবি পারসোনাল। আত্মজৈবনিক। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে নিজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও অভিজ্ঞতা তিনি ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। অবশ্য এই সোসাইটি স্ট্রাকচারের সাথে আমাদের পরিচয় কম। যে কোনো দেশে একটি সোসাইটির বিভিন্ন স্তর থাকে। এ–ছবিতে যে সোশ্যাল লেভলটা আমরা দেখি তা অনেক ওপরের। অনেকটা অচেনা হলেও তারও তো অস্তিত্ব বিদ্যমান। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটা দিকও আমরা দেখতে পাই ছবিতে। সে আন্ডারওয়ার্ল্ড কেবল রক্তাক্ত ভায়োলেন্সের নয়; অস্থির, দুর্নীতিগ্রস্ত জন অহিতকারী ও স্বার্থনির্ভর রাজনীতি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা টানাপোড়েন এসবও এসেছে এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের আখ্যানে। এসব অস্থিতিশীলতার কারণে যুব ও অগ্রজ সমাজে সৃষ্ট নানা হতাশায় চিত্রও আমরা দেখি মাশরুরের ৮৩ মিনিটের ছবি গোয়িং হোমে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মাশরুরের একটি ভালোবাসার বিষয় লক্ষণীয় এ–ছবিতে প্রথম থেকে। এটা মনে হয় তাঁর সহজাত যা তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পিতা মাসুদ পারভেজের কাছ থেকে জারিত।
পরিচালক যদিও বলেছেন, তাঁর ছবি নন ন্যারেটিভ ও নন লিনিয়ার, তারপরেও গতিময় একটা ন্যারেটিভিটি আমরা ছবিতে পাই। এটা চমৎকার সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ ও চিত্রনাট্যের কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে পুরো ছবির সম্পাদনার সাথে তুলনা করতে গেলে কয়েকটি দৃশ্য অহেতুক দীর্ঘ মনে হয়। ছবিটিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আবহ সংগীতও বড় ভূমিকা রেখেছে।
ছবির স্টোরিলাইন খুব সাধারণ হলেও অবশ্যই বহুমাত্রিক। একজন মানুষ রাতে বাড়িতে ফেরার পথে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। তার অতীত জীবনে একের পর এক ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা যা তাকে এখন বারবার পীড়া দিচ্ছে এবং তার জীবনকে জটিল করে তুলেছে তা যেন সে একটার পর একটা চোখের সামনে দেখতে পায়, যা তার চলার পথকে অবরুদ্ধ করে রাখে। অন্যদিকে একজন মানুষের হতাশার কথাও উঠে আসে যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল যে স্বাধীন দেশটির আকাঙ্ক্ষায় সে দেশকে সে পেয়েও পায়নি। হারিয়েছে। ছবির প্রতিটি চরিত্র হতাশাগ্রস্ত কিন্তু শান্তি খুঁজে পেতে চায়, এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায়, যদিও তারা জানে এসব কৃতকর্র্মের তারাও কমবেশি দায়ী।
ছবির স্টোরিলাইন ও মেকিং দুটোই সমানতালের। এটা প্রশংসনীয়। ছবিটি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দি জিরোটু’ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছে। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে আগস্টে প্রদর্শিত হলো। ছবিতে রাইয়ান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাশরুর পারভেজ নিজে। অন্যান্য চরিত্রে সোহেল রানা, জিনাত বেগম, ফাহিম ফারুক, নুসরাত জাহান জেরি, মাহবুবুল ইসলাম, শঙ্খ পাঞ্জা এবং কবিগুরু অভি। চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় মাশরুর পারভেজ, চিত্র গ্রহণে জাহিদ হোসেন, সম্পাদনা ও রঙ বিন্যাসে ফাহাদ হাসান, শব্দ পরিকল্পনায় কৌস্তভ সেন রবাট এবং আবহ সংগীত নির্মাণে জাহিদ বাশার পংকজ ও অর্ক সুমন। গোয়িং হোম প্রযোজনা করেছেন জিনাত বেগম ও মাসুদ পারভেজ।
ছবির নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী সকলেই তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী। তাঁদের মধ্যে যে উদ্দীপনা লক্ষণীয় এবং ছবির কাহিনীতে তরুণ নির্মাতা যে সচেতনতা ও প্রত্যাশার ইঙ্গিত দেন, সব মিলে আমরাও একটা সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্রিক পরিবেশের সন্ধান পেয়ে যাই। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরীক্ষাধর্মী ধারা যে গড়ে উঠেছে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ‘গোয়িং টু হোম’।