গোফরান উদ্দীন টিটু’র নির্বাচিত ছড়া

জসিম উদ্দিন খান | বৃহস্পতিবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ

গোফরান উদ্দীন টিটু চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশে ছড়া সাহিত্যে অতি পরিচিত একটি মুখ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও ছড়া সাহিত্য চর্চায় তিনি অত্যন্ত সাবলীল ও কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং সেই লেখালেখি শুরুর অগ্রযাত্রাকে তিনি টেনে নিয়েছেন বহুদূর। তাঁর এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানামুখী লেখার পাশাপাশি ছড়া চর্চার ক্ষেত্রটি আপন মহিমায় উজ্জ্বল। পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা ছড়া আমাদের পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেএ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ছোট ছোট বাক্যে ছটুল ছন্দের ছড়া নির্মাণে তিনি অত্যন্ত সাবলীল। বিষয় বিন্যাস ও নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়ের তাঁর ছড়া আমাদের কাছে নানারূপে ধরা দিয়েছে। চট্টগ্রামে যে কয়জন ছড়াকার দীর্ঘদিন ধরে ছড়া চর্চায় নিবেদিত আছেন গোফরান উদ্দীন টিটু তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর দীর্ঘ সময়ের লেখালেখির যে বিশালতা বা ব্যাপ্তি, সে বিশালতার মধ্যে প্রাপ্তির পরিমাণ অনেক কম। তাঁর ছড়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ থেকে ছড়ার নির্যাস ঘেঁটে তুলে আনার প্রয়াস ‘নির্বাচিত ছড়া’ নিয়ে এ সংকলন।

এ বইয়ে গোফরান উদ্দীন টিটুর ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সাতটি ছড়ার বই থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছড়া স্থান পেয়েছে এবং এ সংখ্যা প্রায় শতাধিক। বইটির ভূমিকায় গোফরান উদ্দীন টিটুর ছড়া সাহিত্য চর্চার নানা দিক নিয়ে দেশের খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রাশেদ রউফের চমৎকার একটি মূল্যায়নধর্মী লেখা আছে। রাশেদ রউফের এই লেখার বাইরে গিয়ে গোফরান উদ্দীন টিটুর ছড়া সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা সত্যি দুরূহ এবং আমার জন্য এটা কঠিন একটি কাজ। কারণ এই বইয়ে প্রকাশিত অনেক ছড়া সম্পর্কে রাশেদ রউফের চমৎকার আলোচনা আছে। আমি সে সব আলোচনা বাইরে রেখে তাঁর অন্য কিছু লেখা ছড়া আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

গোফরান উদ্দীন টিটুর মোট ১২টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। এই গ্রন্থগুলোর মধ্য থেকে আমার ছড়া কইবে কথা, নাশরাহর জন্য, নাশরাহর জন্য ছড়া, বই পড়ুয়া কাকতাড়ুয়া, এলিজি, মা ও হাসবে বাংলাদেশ নামক শিশুতোষ গ্রন্থ থেকে ছড়াগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। ছড়া নির্বাচনে লেখকের যথেষ্ট যত্নশীলতার ছাপ লক্ষণীয়। একটি শিশুর মনোজগতকে দোলা দিতে পারে এমন সহজ সরল বাক্য বিন্যাসের দারুণ মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন ছড়াকার। যেমনএকটি আকাশ শুভ্র সুনীল/ একটি আকাশ ভালো / একটি আকাশ চাঁদ ঝিলমিল/ ঝমমকে জমকালো। একটি আকাশ ভালোবাসার/ একটি আকাশ প্রাণের/একটি আকাশ আলোআশার/আনন্দময় গানের। (একটি আকাশপৃষ্ঠা১২), আবার, স্বপ্ন রঙিন ভবিষ্যতের সেইতো প্রথম পথচলা/ভুলতে পারি সে কখনো জীবনেও যায় ভোলা!/ হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে শিশুটি পা বাড়ায়/ ছেলেবেলার হাতটি ধরে সে কখনো পথ হারায়? (ছেলেবেলা পৃষ্ঠা১৩)। এমন সব চমৎকার শিশুতোষ ছড়ায় সমৃদ্ধ নির্বাচিত ছড়া গ্রন্থটি। স্বরবৃত্ত ছন্দের এমন কারুকাজ শুধু শিশুদের নয়, যে কোনো ধরনের পাঠককে টানবেই এ ধরনের ছড়া।

আমাদের বাংলাসাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্র ও নজরুলকে নিয়েও ছড়া স্থান পেয়েছে এ বইতে। নজরুল, তোমার বাড়ি আমার বুকে, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নামের ছড়াগুলো অনন্য সুন্দর।

টিটুর ছড়ায় মা এসেছে নানা বিচিত্র আবেগের বিচিত্র বর্ণনায়। একটি ছড়াগ্রন্থ শুধুমাত্র মাকে নিয়েই রচিত। ২০২০ সালে করুণ করোনাকালে মাকে হারিয়ে ভীষণ শোকগ্রস্ত ছিলেন টিটু। তারই অশ্রুভেজা শোকাঞ্জলি মা। এ নির্বাচিত ছড়া গ্রন্থে ছড়াকারের গ্রন্থ ‘মা’ থেকে সংকলিত হয়েছে প্রায় ২২টি ছড়া। মা মানেই প্রিয়জন, মা নামেই আছে জাদুরছোঁয়া এক সম্মোহনী শক্তি। মাকে নিয়ে সব লেখকই লিখেছেন। কতভাবেই না মা লেখকের নানা কল্পনার চিত্রায়নে চিত্রায়িত হয়েছেন তা কল্পনাতীত। ছড়াকারের লেখায় সবার সেরা মা, মায়ের কথা, আমার মাকে, মা মণি, মাগো তুমি, ফিরে এসো মা, বড় আপন মা, মায়ের শোকে, মায়ের দোয়া, প্রিয় মা, মাকে মনে পড়ে নামের ছড়াগুলোর ছত্রে ছত্রে ঝরেছে মায়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা। একটি ছড়ার শেষে ছড়াকার লিখছেনমাকে যখন ছবিই ভাবি/ তখনই ঘুম ভাঙে/ মা যে আমার হারিয়ে গেছেন/ অচিন নদীর গাঙে/

ছড়াকার গোফরান উদ্দীন টিটুর কন্যা নাশরাহ্‌ কে নিয়ে অনেক ছড়া বইতে স্থান পেয়েছে। ‘নাশরাহ্‌ পরি’ ছড়াতে ছড়াকার লিখছেনছোট্ট পুতুল সোনা/ আদরের ধন, হাসিতেই জয় করে/ সকলের মন কিংবা নাশরাহ্‌ র ছড়ায়খেলবে যখন যত খুশি/ জাগব সারারাত, নাশরাহ্‌ যে এক ছোট্ট পরি/ সুখের ধারাপাত। সুখের ছড়ানামক ছড়াতে লিখেছেন, দুষ্ট দুষ্ট চোখ দুটো তার/ মিষ্টি মিষ্টি মুখ,/ আহা কী পরম সুখ! কচি কচি হাত দুটো তার/ ছোট্ট ছোট্ট পা, সেই তো আমার মা। ছোট্ট নাশরাহ্‌ র জন্য কী সুন্দরভাবে লিখলেন ছড়াকার গোফরান উদ্দীন টিটু।! নাশরাহ্‌ র জন্য এ রকম অনেক ছড়া আছে বইতে, যে ছড়াগুলো পড়ে বোঝা যায় ছড়াকার বিভিন্ন বয়সে নাশরাহ্‌েক নানাভাবে তুলে এনেছেন। নাশরাহ্‌ জন্মদিনকে নিয়ে অনেক ছড়া আছে এবং জন্মদিনের ভালোবাসাও প্রকাশ পেয়েছে ছড়াতে এভাবেমেয়ে যেন মানুষটি হয়/ সত্যিকারের সুখি, জীবন সুখের হোক না মাগো/ ও প্রিয় টুকটুকি কিংবা আজ সুখেরই ঝর্ণা ছুটুক/ খুশির বীণে, নাশরাহ্‌ তোমার জন্মদিনে, জন্মদিনে।

বই পড়ুয়া কাক তাড়ুয়া’ গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু ছড়া এই বইতে রাখা হয়েছে। একেবারে শিশুতোষ ধরনের ছড়াকে এখানে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমন সব ছড়াকে নিটোল শিশুতোষ ছড়া বলা যায়। ছড়ার চমৎকার ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত। এখানে উল্লেখ্য পঙ্‌ক্িতগুলোতে স্বরবৃত্তের প্রাধান্য ছড়াকে একধরনের গতিময়তা দিয়েছে।

তাঁর এ ছড়ার বইতে ‘এলিজি’ নামক গ্রন্থের ছড়াগুলো কিছু গুণী ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে রচিত। এখানে সৈয়দা জমিলা খাতুন, অধ্যাপক খালেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, নুর মোহাম্মদ রফিক, রমা চৌধুরী, অধ্যক্ষ শেখর দস্তিদার, মুহাম্মদ আলী শাহ, মোহাম্মদ ইব্রাহিম চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন জনি, বোরহান উদ্দিন সিদ্দিকী, রমজান আলী মামুন, আনিস উদ্দিন মাহমুদ, চৈতি বড়ুয়া, ফারুক হাসানের মত প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা ছড়াকারের প্রিয় কিছু মানুষকে নিয়ে ছড়া লিখেছেন ছড়াকার। ছড়ার সাথে অনেকের জন্মমৃত্যুর তারিখ ও ছবিও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এটা এক ধরনের নতুনত্বই মনে হয়েছে। ছোট ছোট বাক্য বিন্যাসে ছড়াগুলো পড়লেই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে একটি ধারণা মিলতে পারে। ‘হাসবে বাংলাদেশ’ থেকে ছড়া সংকলিত হয়েছে ২৫টি। এখানে চমৎকার ছন্দময় ছড়া আছে। যেমনমন ভালো নেই ফুল পাখিদের/ প্রজাপতির ভালো কি, মন ভালো নেই জোনাকিদের জ্বাললো বনে আলো কি? (মন ভালো নেইপৃষ্ঠা১৩৩), পুকুরের জল বড় টলমল/ চোখ ছলছল হাসিতে, বিজয়ের সুর নয় মোটে দূর/ এই ভালোবাসাবাসিতে (হাসবে বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা১৩৭), স্বাধীনতা মানে পাখির পালক/ বাতাসের দোল খাওয়া, ধানক্ষেত ছেড়ে বহুদূর গিয়ে/ নদীতে স্নিগ্ধ নাওয়া (স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা১৫২)। বইয়ের এ অংশে জাতির পিতা, প্রিয় বাবা, মা ও খোকা, বাগধারা, হাসি নামেরও কিছু ছড়া আছে যা পড়লে পাঠকদের ভালো লাগবে।

পুরো বইয়ের ছড়াগুলোতে ছড়ার ছন্দ স্বরবৃত্তের প্রাধান্য দেখা যায়। গানের সাথে ছড়ার ছন্দের মিল থাকলেও ছড়াকে হতে হয় অনেক বেশি ছন্দ সচেতন। গানের ক্ষেত্রে ও ছন্দের প্রাধান্য আছে সত্য কিন্তু ছন্দ অনেক ক্ষেত্রে সুরের কারণে গৌণ হয়ে যায়। তবুও আমার বিশ্বাস ছড়াকার একজন গীতিকার হিসেবেও ভালো করবেন। তাঁর ছড়াগুলিকে ছড়া গানে রূপান্তর করলে বা আবৃত্তি শিল্পীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হলে আশা করি ছড়াশিল্পী গোফরান উদ্দীন টিটুর ছড়া আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে। আমরা জানতে পারি যে, কলেজজীবনেই তাঁর গ্রন্থভুক্ত অনেক ছড়াই ছড়াগানে রূপান্তরিত হয়েছিল।

গোফরান উদ্দীন টিটুর কিছু কিছু ছড়াতে ছন্দের টানটান হওয়ার যে প্রবণতা তাতে কিছুটা ঘাটতি লক্ষণীয় এবং কিছু কিছু ছড়ায় দুর্বল অন্ত্যমিলের দেখাও মেলে। এটি হয়তো অবচেতন মনেরই প্রকাশ। একটু সচেতনতা হলেই গোফরান উদ্দিন টিটুর মত ছড়াকাররা তা কাটিয়ে ওঠার অবশ্যই সক্ষমতা রাখেন। কবি বইটিকে নির্বাচিত ছড়ানাম দিলেও এতে আছে বেশকিছু অপূর্ব কিশোরকবিতাও। ভবিষ্যতে কবি নির্বাচিত কিশোরকবিতাসংকলন প্রকাশ করলে তাতেও এ কবিতাগুলো স্থান পেতে পারে। সব মিলিয়ে অধ্যাপক গোফরান উদ্দীন টিটুকে একজন জাত ছড়াশিল্পী হিসেবেই আমরা পাই নির্বাচিত ছড়াগ্রন্থে। সামগ্রিক বিচারে দারুণ প্রচ্ছদে রাদিয়ার এটি একটি চমৎকার প্রকাশনা। ১৫২ পৃষ্ঠার এ বইটি প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ এবং শিল্পী উত্তম সেনের আঁকা কবির দুইটি প্রতিকৃতিও এক কথায় অসাধারণ।

লেখক : কবি ও গীতিকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোজ জীবনের খোঁজ
পরবর্তী নিবন্ধভারতের সর্বসাম্প্রতিক পরিস্থিতি : রূঢ় মূঢ়তার বিপন্ন বিস্ময়