জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশকে ঘিরে সকাল থেকে দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হাতবোমা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের বিকট শব্দ আর ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। গোটা শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সবশেষ চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এসব হামলা, ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ায় অন্তত চারজন নিহত হওয়ার খবর এসেছে। খবর বিডিনিউজের।
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বুধবার রাত ৮টায় বলেন, আমাদের এখানে চারজনের মরদেহ আনা হয়েছে। নিহতরা হলেন– শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রজমান কাজী (১৯), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, তারা তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যা বাড়তে পারে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এনসিপির এই পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার–প্রচারণা চালানো হয়। বুধবার সকালে এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরে ইউএনওর গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এসবের মধ্যে বেলা দেড়টার দিকে নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে এসে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায়।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে দুপুর পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলা হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। দুপুরে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। পরে বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারির কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
একজন সংবাদকর্মী জেলা কারাগারে হামলার কথা জানিয়ে বলেন, ৪টার দিকে কারাগারের ফটকে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এসে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে হামলাকারীরা কারাগারের ভেতর যেতে পারেননি; কারাগারের কোনো আসামিও বাইরে আসতে পারেননি। তবে এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও জেলা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সমাবেশস্থলের চেয়ারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তায় এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে প্রচুর গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সমাবেশ এলাকায় আগুন দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হামলাকারীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারা চৌরঙ্গী মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখানে প্রচুর লোকজন। তাদের হাতে লাঠি দেখা গেছে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করছেন। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে তাদের পিছু হটানোর চেষ্টা করে। শহরে থমথমে পরিস্থিতি দেখা গেছে।
সাঁজোয়া যানে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছাড়েন এনসিপি নেতারা : সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে আটকাপড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছেড়েছেন। বিকালে অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম) খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, এনসিপির নেতা কর্মীরা গোপালগঞ্জ এসপি অফিসে আটকা ছিলেন। পরে সোয়া ৫টার দিকে ক্লিয়ার হলে তারা চলে যান।
জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় চত্বরে এনসিপি নেতাদের সাঁজোয়া যানে উঠার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন। এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে একটি সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এনসিপি নেতা সারজিস আলম, তিনি বেরিয়ে এসে হাসনাত আব্দুল্লাহকে নিয়ে আবার সাঁজোয়া যানে প্রবেশ করেন। সেখানে থাকা সেনাসদস্যরা তাদের সাঁজোয়া যানের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করেন। সারজিস ও হাসনাত আব্দুল্লাহ গাড়ির ভেতরে ঢোকার পর সেখানে প্রবেশ করেন। তারপর সেখানে এনসিপি নেতা আখতার হোসেন আসেন। কিন্তু তাকে সেই গাড়িতে না তুলে পাশের একটি গাড়িতে তোলা হয়। আরেকটি ভিডিওতে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকেও একই ধরনের সাঁজোয়া যানে উঠতে দেখা গেছে।
জানা যায়, গোপালগঞ্জ থেকে গাড়ি বহর নিয়ে খুলনায় পৌঁছেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) কেন্দ্রীয় নেতারা। আজ বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে গাড়িবহর নিয়ে তারা খুলনা শহরে ঢোকেন। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমীন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা খুলনা সার্কিট হাউসে এবং অন্য নেতারা একটি হোটেলে উঠেছেন।
গোপালগঞ্জে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচি ঘিরে হামলা–সংঘর্ষের ঘটনায় কারফিউ জারি হওয়ায় গোপালগঞ্জ জেলার বৃহস্পতিবারের এইচএসসির ভূগোল দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন অন্যান্য জেলা এবং বোর্ডে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
কারফিউয়ের গোপালগঞ্জে থমথমে রাত : জাতীয় নাগরিক পার্টির–এনসিপি পদযাত্রা ও সমাবেশকে ঘিরে সারাদিন দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার পর কারফিউ জারি করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে শহরের কোথাও কোনো হামলা বা ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা না ঘটলেও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
শহরে রাত ৮টা থেকে কারফিউ শুরু হয়েছে। স্পর্শকাতর স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর টহল চলছে। রাত সাড়ে ৮টায় শহর মোটামুটি শান্ত দেখা গেছে। শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। শহরে যান চলাচল নেই বললেই চলে। যে কয়েকজনকে রাস্তায় দেখা গেছে তারাও বাড়িমুখো। তাদের চোখে–মুখে আতঙ্ক দেখা গেছে।
রাত সাড়ে ৮টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এখন শহর শান্ত আছে। হামলাকারীরা কোথাও কোথাও আছে। তবে পুলিশের সঙ্গে তারা মুখোমুখি অবস্থানে নেই।
গোপালগঞ্জে হামলায় জড়িত সবাইকে শাস্তি পেতে হবে : গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিতে হামলার ঘটনাকে মানবাধিকারের লজ্জাজনক লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এ জঘন্য হামলায় জড়িত কেউই শাস্তির বাইরে থাকবে না, যা কিনা নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, আজ গোপালগঞ্জে যে সহিংসতা হয়েছে, তা একেবারের অগ্রহণযোগ্য। বিপ্লবী জুলাই আন্দোলনের বছরপূর্তিতে তরুণ নাগরিকদের ডাকা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলার ঘটনাটি মানবাধিকারের লজ্জাজনক লঙ্ঘন।
অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মী, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে নৃশংস হামলা চালানো হয়। তাদের গাড়ি ভাঙচুর করার পাশাপাশি অনেকের ওপর সহিংস আক্রমণ হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশের যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সেনাবাহিনী ও পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রশংসা করি। এছাড়া হামলা সত্ত্বেও আমরা সেই সব শিক্ষার্থী ও মানুষের সাহস আর দৃঢ়তার প্রশংসা করি, যারা এমন নৃশংস হামলার পরও সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন। এই নৃশংস হামলায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা স্পষ্ট করে বলতেই হয়– এ দেশে সহিংসতার কোনো স্থান নেই; ন্যায়বিচারের জয় হবেই হবে।