পর্ব–৮
মানুষ কেন মেঘ হতে চায়? মন খারাপের ছাই থেকে কেন ফিনিক্স পাখির আশা দেখে? সিঁড়ির গোড়ায় প্রজ্ঞার দেবী কেন প্রশ্ন করে, এই পৃথিবীতে হত্যার মত বিষয় না থাকলে কি হতো? সকল পাপের শাস্তি হত্যা ব্যতীত হতো? এমন দেশ কি নেই, যেখানে বেয়োনেটের কথা কেউ জানে না? মেঘেরা উড়ে গেলে, রৌদ্র মুখে আমরাও জানি ক্ষমতাই সকল ক্ষমতার উৎস। দেশ মানেই সীমানা, আর সীমানা মানেই বিভাজন, আমার–তোমার হিসাব কষা। হিসেবে গড়মিল তো হয়, এরপর সংঘাত, বেশি যেতেই যুদ্ধ। যুদ্ধ–স্বদেশে সকল হত্যা জায়েজ যখন, কেউ আর কোনোদিন পাখি হতে পারে না, তারা থেকে যায় আদি থেকে অন্ত মানুষ হয়ে।
এ পৃথিবী মানুষের, ইতিহাসগুলোও মানুষের! ফলত তারাই নতুন ইতিহাস গড়ে, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলে পুরানো অনেক সত্য, ইতিহাসই আবার সকল মিথ্যার শেষে দিন গুনে সত্যকে সামনে আনে। তবে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির মতো মানুষেরা আদতে সেই বিড়ালছানা, যারা আছে অথবা নেই। আমরা থাকি বা না থাকি, কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেছে জানি। যুদ্ধ মানেই যুদ্ধ। এর কোনো প্রতিশব্দ হয় না। যেখানেই যুদ্ধ হয়েছে, সেখানেই নির্বিচারে সকলে জড়িয়েছে, যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সবচেয়ে বেশি যা হয় তা হলো, ইতিহাসকে বিকৃত করা, মুছে ফেলা। স্বার্থের নিয়মে ইতিহাসকে সাজিয়ে টেবিলে পেশ করা। তবুও কেউ কেউ সমস্ত সময় ধরেই, কেবল আঁচ করেন। ফলত আমরা যেমন বীরাঙ্গনাদের কথা জানতে পারি, তেমনই কল্পনা চাকমার কথা মনে রাখি, বেগম রোকেয়াকে আঁকড়ে ধরি, কখনো নুসরাত–তনু–মুনিয়ার জন্যে প্রতিবাদ জানাই, আবার কখনো নুসরাত তাবাসসুমের অধিকারের জন্যে লড়াই করি। আমরা প্রত্যেকেই জানি, স্বচ্ছ চোখে যা কিছু দেখানো হয় তা সত্য নয়, আমরা এসব মানি বলেই সত্যটাও বেরিয়ে আসে।
যুদ্ধের ইতিহাসে হিটলারের কথা যতবার উঠবে ততবার মনে পড়বে, হিটলার নিজেকে শ্যুট করে আত্মহত্যা করেছিলো। যুদ্ধ বললেই, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি একজন মানুষকে কাঁদাবে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালে স্পেনের সামরিক যুদ্ধও ছিল স্বাধীনতাকামী মানুষের যুদ্ধ। তবে যেকোনো পক্ষের স্বাধীনতাই অপর পক্ষে নির্বিচারে হত্যার জন্যে দায়ী হয়। ফলত প্রেম এবং যুদ্ধে যে–কোনো কর্মের বৈধতাই আপনাকে আগ্রাসী রূপ দেয়।
বৈধতা আর বিরোধিতার মাঝে এক পাতলা পর্দা আছে, পর্দাগুলোর সাহায্যেই আলোকচিত্রীরা ইমেজের ডকুমেন্টেশন করে যান বারবার। যুদ্ধের ডকুমেন্টেশনে তাই আলোকচিত্রীদের অনন্য অবদান কেউ নাকচ করতে পারেন না, তবুও প্রশ্ন আসে যুদ্ধ কি তুমি থামাতে পেরেছিলে? এই নিপীড়ন না থামিয়ে, বসে বসে ছবি তুলছিলে কেন? ‘না যুদ্ধ থামানো যায়নি, তবে এর ভয়াবহতা জানানো যায়। আলোকে সত্যের উপর ন্যস্ত হতেই হয় বরং চুপ করে থাকার চেয়ে এই লড়াই আরো মহৎ।’ আর এই সত্যকে উন্মোচন করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন গেরদা তারো, যার নিজের ইতিহাসকেও মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছে বহুবার।
জার্মানির শিল্পোন্নত এক শহরে ১৯১০ সালে জন্ম গেরদা তারো’র। যার বাবা মায়েরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অভিবাসী হিসেবে জার্মানে এসেছিলেন। পরবর্তীতে স্পেনের দ্বিতীয় সামরিক যুদ্ধকে কভার করতে গেরদা তারো জার্মান ছেড়ে যান। আলোকচিত্রই যেমন যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে, তেমনই পারে ভালোবাসা ছড়াতে। ১৯৩৪ সালে এন্ড্রু ফ্রাইডম্যান প্যারিসে একজন নারী মডেলকে খুঁজে ফিরছিলেন, অভিবাসীদের নিয়ে এক এলবামের জন্যে। সেখানে তার পরিচয় গেরদার সাথে। ইতিহাসে আলোকচিত্রের জগতে সবচেয়ে রাজনৈতিক এবং পেশাগত শক্তিসম্পন্ন সম্পর্কের উত্থান হয় গেরদা আর এন্ড্রুর মাঝে। এন্ড্রু নাম পরিবর্তন করে রাখে রবার্ট কাপা এবং গেরদা নিজের নাম দেয় গেরদা তারো। একসাথে আলোকচিত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করেন, দুজনই আলোকচিত্রী হিসেবে নিজেদের এক ফর্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তথাকথিত আলোকচিত্রের ভাবনা থেকে বের হয়ে ডি–ডে ল্যান্ডিং ইমেজের আবির্ভাব করেন। একই সাথে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ ওয়ার’ এর মতো বিখ্যাত গল্পেরও জন্ম দেন।
গেরদা তারো নারী ফটো–জার্নালিস্ট হিসেবে অধিক স্বীকৃতি প্রাপ্য। ১৯৩৬ সালে তারো এবং কাপা দুজনই ফ্রান্স প্রেসের জন্যে ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে স্পেনে যান। পরবর্তীতে ফটো–জার্নালিস্ট পেশার একজন পথ–প্রদর্শক হিসেবে, স্পেনের সামরিক যুদ্ধের সামনের সারি থেকে বেশ কিছু বিখ্যাত ছবি তোলেন। যদিও তার কাজের ধরণকে অনেকেই কাপার সাথে তুলনা করতো। কিন্তু গেরদার কাজগুলো ইন ডেপথ সেন্স ছিল অনেক বেশি। যার ফলে আলাদা এক বৈচিত্র্যই গেরদাকে আরো আগ্রহী করে তোলে।
যুদ্ধে সহ–যোদ্ধার প্রতি যে বিশ্বস্ততা থাকে, তার জেরেই সমস্ত যুদ্ধটা শেষ হতে পারে। সহযাত্রীর আঘাতে তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া, নিজের পোশাক খুলে বন্ধুকে দেওয়া, যোদ্ধাদের এক দন্ড শান্তি খোঁজা কিংবা সৈনিকের ফেলা যাওয়া টুপিকে নিয়ে উল্লাস, সৈনিক বন্ধুর শেষকৃত্যের জন্যে কাফন নিয়ে লং মার্চ ভালোবাসার কতশত রূপ ধরা দিয়েছে গেরদা তারো’র ক্যামেরায়। মানুষ চায় শান্তি, যুদ্ধে কেবল গ্লানি। তবুও মানুষের প্রতি মানুষেরই এই ভালোবাসার সুরকে ধরতে পেরেছিলেন গেরদা তারো।
গেরদা নিজের কাজগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেন লন্ডন নিউজ, লাইভ, রিগার্ডসের মতো ম্যাগাজিনে। ধীরে ধীরে সকলে গেরদার কাজকে প্রশংসা করতে শুরু করেছিলো। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজের মধ্যে ১৯৩৭ সালে জুলাইতে তোলা মর্গের ছবিগুলো অন্যতম। যেখানে মর্গে সারি সারি হাজারো লাশের বাইরে স্বজনেরা ছোটাছুটি করছেন আপন জনের লাশের জন্যে।
জুলাইয়ের শেষের দিকে গেরদা ফ্রান্সে যান আবার ফিরেও আসেন স্পেনে কিন্তু যুদ্ধের গতি বাড়তে থাকলে আটকা পড়েন স্পেনে। ক্যামেরার রিল শেষ না হওয়া অব্দি গেরদা ছবি তুলেছিলেন। এরই মাঝে ১৯৩৭ সালে পহেলা আগস্ট একটি টাংকে হামলা হয় এবং সে টাংক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, সে টাংকের সামনের গাড়িতেই ছিল গেরদা তারো। জখম হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও গেরদার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে গেরদার জন্যে সেদিন হাজারো মানুষ শোক পালন করেন।
গেরদা তারো’র কাজগুলোকে এখনো গোছানোর কাজ চলছে, তাঁর কোনো কাজই এলবাম আকারে তেমন গুছিয়ে রাখার সময় পাননি তিনি। যদিও আইসিপি পরবর্তীতে তাঁর কাজের বিরাট সংরক্ষণ করেছেন বলে দাবি করেন। ২০০৭ সালে পৃথিবীর কাছে গেরদার কাজকে আরো পরিচিত করতে তৃশা যিফ নামক একজন পরিচালক গেরদা এবং কাপার একত্রে করা ‘ম্যাঙিকান স্যুটকেস’ নামক এলবামে আলোকপাত করে। যেখান থেকে যুদ্ধের বেশ কিছু বিখ্যাত ছবির দেখা মিলে। গেরদার কাজে সামরিকদের জীবনে যেভাবে আঁচ করার সুযোগ মিলেছে তা অন্য কোথাও আর পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে গেরদার সবচেয়ে শক্তিশালী মনোভাবনা কাজে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি আপনার ছবিগুলো খুব বেশি ভালো না হয় তাহলে এর খুব বেশি কাছেও আপনি যেতে পারেননি।
গেরদাকে একজন শক্তিশালী রিপোর্টার হিসেবে মানা হতো। সামরিকদের দুঃখ–দুর্দশার সকল ডকুমেন্টেশন গেরদা করেছেন সাহসের সাথে। ‘ভয় পাওয়ার ভয় না থাকা বীরত্ব’ এমনই ভাবতেন গেরদা। তাঁকে একজন বামপন্থী হিরোইন এবং শহীদও মানা হয় কেননা তাঁর জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তে তিনি ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। নিজের বিশ্বাসকে আকঁড়ে ধরে সততা এবং নিষ্ঠার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন সবসময়।
তবুও ইতিহাসের কালে তাকেও লোকে হারিয়ে ফেলেছে, সত্যের আড়ালে। প্রায় ভুলতে বসা গেরদা তারো’কে নিয়ে সিয়ানা ফেডেরিকো তার ইউটিউব চ্যানেলে ‘গেরদা তারো–লস্ট বিহাইন্ড অ্যা লেন্স’ নামক একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। এছাড়া তাঁর কাজের সংরক্ষণ খুবই কম বলা যায়। কেন গেরদা তারো’কে মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছে, তাঁর সহযাত্রী রবার্ট কাপা কেন তাঁর কাজকে পরবর্তীতে সংরক্ষণে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি, এসব প্রশ্ন করে যেতে হবে হয়তো। যৌবনের মধ্য বসন্তে গেরদা তারোর ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে এই লড়াই আমাদের জন্যে দিকনির্দেশনা, তেমনই চরম শিক্ষাও। আমরা যাদের ভুলে যাই তাদের কাজগুলো ঠিকই কোথাও না কোথাও টুকে থাকে, আমাদের কেবল সেই দরজায় পৌঁছাতে হবে। এতটুকুতেই হয়তো অসংখ্য ত্যাগকে সাার্থকতা এনে দিবে।