মাত্র দেড় দিনের বিদ্রোহ ২৩ বছরের শাসনামলে গড়ে ওঠা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘স্ট্রং ম্যান’ ইমেজে যে জোর ধাক্কা দিয়েছে তা সামলে উঠতে কী করতে চলেছেন তিনি। তিনি আদৌ এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিবিসি–র বিশ্ব সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক জন সিম্পসন বলেন, গত ২০ বছরের বেশি সময় পুতিন অনেক উত্থান–পতন দেখেছেন বটে। কিন্তু সবসময় তিনি তার ‘বিগ বস’ সুলভ ইমেজ সাফল্যের সঙ্গে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু শনিবার যেটা হলো তা তার শাসন ব্যবস্থার খুব খুবই দুর্বলাবস্থা প্রকাশ করেছে।’ পুতিনের খালি গায়ে ঘোড়ায় চড়া বা কুস্তি লড়ার ছবিগুলোর কথা উল্লেখ করে সিম্পসন আরো বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই তার ওই ছবিগুলোর কথা মনে করতে পারছেন। ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের উত্থান তার ওই সব কিছুকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সত্যি বলতে, অদ্ভুত এক অপরাধী পটভূমির সাথে তিনি প্রিগোজিনের মত একজন অহংকারী ও দাম্ভিক মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন….যিনি নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার উপর ভিত্তি করে খুবই আকর্ষনীয় একটি সামরিক সংস্থা গড়ে তুলেছেন। যার ফলে এখন পুতিনের পুরো কাঠামো ধসে পড়তে শুরু করেছে।’
শনিবার ভোররাতে হঠাৎ করেই পুরো বিশ্ব অবাক চোখে দেখতে থাকে পুতিনের প্রশ্রয়েই এতদিন বেড়ে ওঠা একটি বাহিনী প্রবল আক্রোশ নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেছে। ইয়েভগেনি প্রিগোজিন, যাকে ‘পুতিন্স শেফ’ নামে ডাকা হত। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি পুতিনের প্রতি তার অনুগত্যের প্রমাণ বার বার দিয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের সবচেয়ে আগ্রাসী বাহিনী হয়ে ওঠে প্রিগোজিনের যোদ্ধারা। গত মাসেও এই ওয়াগনার বাহিনী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে রাশিয়াকে ইউক্রেনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাখমুত শহরের দখল পাইয়ে দিয়েছে।
ওয়াগনাররা যতটা আচমকা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছিল, বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় ততটা দ্রুতই সেই বিদ্রোহের অবসান হয়েছে। কিন্তু মস্কোর আকাশ থেকে সংকটের কালো মেঘ কী আসলেই কেটে গেছে। বিশেষজ্ঞরা অন্তত তেমনটা ভাবতে নারাজ। তবে দেড় দিনের এ বিদ্রোহ রাশিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। পুরো বিশ্ব গভীর সংশয় নিয়ে শনিবার দিনভর চলা এ ঘটনার উপর নজর রেখেছে। আর ইউক্রেনে হয়েছে উল্লাস।
প্রিগোজিনের সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছে ক্রেমলিন। সে সমঝোতার বিস্তারিতও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রিগোজিনের প্রতি এই জনসমর্থন স্বাভাবিকভাবেই মস্কোর কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাজ ফেলেছে। এখনো অনেক কিছুই ধোঁয়াশার মধ্যে রয়ে গেছে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিরল এই বিদ্রোহ কোনো পরিণতি ছাড়াই এত দ্রুত শেষ হওয়ার কথা না।
ওয়াগনার বাহিনীতে প্রিগোজিনের ভূমিকা এরপর কী হবে, ইউক্রেন যুদ্ধেই বা তার ভূমিকা কী হতে চলেছে, তার বাহিনীর সবাই রাশিয়ার সেনাবিহনীর সঙ্গে চুক্তি করতে চলেছে কিনা, এমন অনেক কিছুই এখনো অস্পষ্ট। প্রিগোজিন রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশ চলে যাচ্ছেন বলে জানালেও সেখানে তার ভূমিকা কী হতে চলেছে সে বিষয়ে কিছুই জানাননি ক্রেমলিন মুখপাত্র। তিনি বলেন, তিনি এসব প্রশ্নের ‘উত্তর দিতে পারবেন না’।
তবে বিপদ শুধু মস্কোর মাথার উপরই রয়ে গেছে বিষয়টা এমন নয় বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। বরং প্রিগোজিনের বিপদও এখনো কাটেনি। মস্কোয় সিএনএন এর সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জিল ডগার্টি বলেন, ‘পুতিন বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করেন না। যদিও পুতিন বলেছেন, ‘প্রিগোজিন, আপনি বেলারুশ চলে যান– কিন্তু তিনি এখনো একজন বিশ্বাসঘাতকই রয়ে গেছেন এবং আমার মনে হয়, পুতিন তাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।’
প্রিগোজিনের ওয়াগনার যোদ্ধারা মস্কোর দিকে যাত্রা শুরুর পর টেলিভিশনে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে পুতিন ওয়াগনার প্রধানের নাম উল্লেখ না করে তাদের ‘পিঠে ছুরি মেরেছে’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে বর্ণনা করেন। টেলিভিশনে ওই ভাষণের পর থেকে পুতিনকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি বা বিদ্রোহীদের ফিরে যাওয়া নিয়েও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। খুব শীঘ্রই তার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও ক্রেমলিন থেকে জানানো হয়ছে। তবে পুতিন বর্তমানে মস্কোয় অবস্থান করছেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
কেউ কেউ বলছেন, বিদ্রোহের কারণে পুতিনের যে দুর্বল ভাবমূর্তি প্রকাশ পেয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে তিনি পাল্টা আক্রমণ করবেনই করবেন। এজন্য হয় তিনি ইউক্রেনে আক্রমণ আরো জোরদার করতে পারেন, অথবা দেশের ভেতর বিরোধীদের উপর আরো খড়গহস্ত হবেন। পুতিন সমালোচকরা অবশ্য শনিবারের ওই বিদ্রোহকে ‘পুতিনের শেষের শুরু’ বলে মনে করছেন। অপরদিকে রাশিয়ার সরকার যে কিছুটা সংকটে পড়েছে তা পুতিনের সাবেক এক উপদেষ্টাও স্বীকার করে নিয়েছেন।