গৃহকর্মী নির্যাতন নয়, প্রয়োজন সুরক্ষা

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | শুক্রবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

একজন গৃহকর্মী হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি একটি পরিবারে বা গৃহে গৃহস্থালি কাজকর্মে সহায়ক হিসেবে সার্বক্ষণিক বা খন্ডকালীন সময়ের জন্য সেবায় নিবেদিত থাকেন। গৃহকর্মীরা গৃহ কর্তা বা গৃহকর্তীর ফরমায়েশ মতো গৃহের পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণ, রান্না বান্না,শিশু, বয়স্ক ও নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের যত্ন নেওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় গৃহস্থালি পরিষেবা সম্পাদন করে থাকেন। গার্হস্থ্য পরিষেবা বিষয়টি পেশাগত দায়িত্বেরই অংশ। কিছু গৃহকর্মী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বসবাস করে, কিছু গৃহকর্মী খন্ডকালীন কর্মসম্পাদন করে তাদের স্ব স্ব বাসাবাড়িতে ফিরে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহস্থালী কাজগুলো চাহিদাপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও এগুলোকে সাধারণত অবমূল্যায়ন করা হয়। অনেক দেশে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা আইন থাকা সত্ত্বেও তা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় না। অনেক সময় গার্হস্থ্য কাজগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। যার ফলে গৃহকর্মীরা দাসত্বসহ গুরুতর নির্যাতনের শিকার হয়।

গৃহকর্মী বা বাসাবাড়ির কর্মচারীদের অবদান, দক্ষ পরিবারের স্বাভাবিক কর্ম ব্যবস্থাপনায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গৃহ কর্মীদের বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়। যেমন ভৃত্য, চাকরচাকরানী, বুয়া ইত্যাদি। আসলে পেশা যাই হোকনা কেন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাবে সম্বোধন করা উচিৎ নয়। ভৃত্য, চাকর, বুয়া সবার প্রতি মানবিক আচরণ পোষণ করে আন্তরিকতার মাধ্যমে সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ২৩২ টি দেশ ও অঞ্চলের জাতীয় জরিপ সমীক্ষা মতে আদম শুমারীর উপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যানে গৃহকর্মীর সংখ্যা অনুমান করা হয় ৬৭.০১ মিলিয়ন। আই এল ও নিজেই বলেছে যে বাস্তবতার কারণে এ ধরনের কাজ অনেকটা লুক্কায়িত বা অনিবন্ধিত। গার্হস্থ কর্মীরা সাধারণত সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী থেকে আসা যাদের শিক্ষার সুযোগ কম। অধিকার সম্পর্কে অবগত নয় বলে তারা প্রায়শই মানসিক ভাবে দুর্বল থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে গৃহ কর্মীরা বেশিরভাগই নারী। গৃহকর্মীরা অন্যান্য পেশার লোকদের তুলনায় নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং বৈষম্যের শিকারে পরিনত হয়। গৃহ কর্মীদের মাঝে অনেক শিশু গৃহকর্মী থাকে যারা মানুষরূপী দানবের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এ ধরনের শিশুরা শোষণের ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়শই তাদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতে হয়। সামান্য বিরতির সুযোগ তাদের দেওয়া হয় না। শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ থাকেনা বিধায় আজীবন তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে। ইউনিসেফ গার্হস্থ্য কাজকে সর্বনিম্ন কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের রিপোর্টে বলা হয় বেশিরভাগ শিশু গৃহকর্মী লিভ ইন কর্মী এবং তারা সার্বক্ষণিক ভাবে নিয়োগ কর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এদের ওপর নির্যাতন যেকোনো নৃশংস বর্বরতাকে হার মানায়। অনুমান করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন শিশু গৃহকর্মীর কাজ করে থাকে।

নারী এবং শিশু গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত এসব কর্মীদের প্রতি নিয়োগ কর্তার অসদাচরণ, অবহেলা ও নির্যাতন খুবই মর্মান্তিক ও ন্যাক্কারজনক। ইউনাইটেড স্টেটস হিউম্যান ট্রাফিকিং হটলাইন গৃহকর্মী নির্যাতনকে মানব পাচারের একটি ধরণ হিসেবে বর্ণনা করে। গৃহকর্মী নির্যাতন একটি বৈশ্বিক ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহ কর্মীরা চরম নির্যাতনের শিকার হয়। তারা শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানান অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। গবেষণায় দেখা গেছে সিঙ্গাপুরে ১০ জন গৃহকর্মীর মধ্যে ৬ জন কর্মক্ষেত্রে কোনো না কোনো অপব্যবহারের সম্মুখীন হয়। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন শারীরিক সহিংসতার শিকারে পরিণত হয়। আমাদের দেশেও অনেক ক্ষেত্রে গৃহকর্মীদের ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন যেমন শারীরিক ভাবে প্রহার, খুন্তি দিয়ে ছেঁকা দেওয়া থেকে শুরু করে এমন পাশবিক নির্যাতন করা হয় যারফলে ভিক্টিম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গৃহকর্মীদের ওপর বৈরী আচরণ করা হয় যা সভ্যতা, সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচারকে হার মানায়। অথচ একমুঠো অন্নের জন্য নারী বা শিশু কর্মীরা গৃহকর্তার অনুকম্পার ওপর নির্ভর করে গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত থাকে। গৃহকর্মীরা গৃহকর্তার আপনজন হয়ে সবসময় পাশে থাশে থাকতে চায়। ছিন্নমূল নারী শিশুরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে সমাজের নিম্নবিত্তের, নিম্ন মধবিত্ত ও উঁচু তলার মানুষের ঘরে গৃহকর্মী (চাকর, বুয়া) হিসেবে কাজ করে। সহায়সম্বলহীন বিধায় এদেরকে বিত্তশালী পরিবারে কাজ করতে হয় জীবন জীবিকার অন্বেষনে। দুর্ভাগ্যবশত প্রাণপণ সেবা দিয়ে এসব গৃহকর্মী গৃহকর্তা বা গৃহকর্তীর সদয় করুণা, স্নেহ, ভালোবাসা লাভ থেকে বঞ্চিত। ভাগ্য বিড়ম্বিত মানবসন্তানরা রাতদিন সেবা দিয়ে পরিবারের সকল সদস্যদের উপকার করে থাকলেও আজীবন তাদের পরিচয় গৃহভৃত্য হিসেবে। সামান্য ভুলভ্রান্তির জন্য এসব নিরীহ গৃহকর্মী দের ওপর চলে আদিম বর্বরোচিত নির্যাতন ও নিষ্পেষণ, যেমন ঘর মুছতে বিলম্ব, রান্না কাজে বিলম্ব ইত্যাদি। অনেক সময় পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যের সাথে গৃহকর্মী নারীর অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ধর্ষিত হয়ে সমস্যা তুলে ধরলেই তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। কখনো কখনো এসব হতদরিদ্র নারী কর্মীর কপালে জুটে মৃত্যু নামের শেষ পরিনতি।

ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে আশ্রিত শিশুনারীদের অভুক্ত রাখা, পঁচা বাসি খাবার খেতে দেওয়া, যৌন হয়রানি, নির্মম প্রহার, হত্যা, খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া, গরম পানি ঢেলে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে দেওয়া যেন অনেকের কাছে সাধারণ বিষয়। বিবেকবোধ নিষ্ক্রিয় বিধায় এমন অমানবিক কাজ তাদের মনে সামান্যতম অনুশোচনা জাগায় না। এসব নির্যাতনের ঘটনা সমাজে সকল পেশায় নিয়োজিত শিক্ষিত পরিবারে ঘটে থাকে। পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত হওয়া এসব লোকের অন্তরে মনুষ্যত্ব বোধ নেই বললেই অত্যুক্তি হবে না। ফলে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় ঘটে চলেছে যেখানে অন্যায় অনৈতিক আচরণ ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা দেখাতে ব্যর্থ। অথচ আমরা চাইলে উদারতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় এসব ভাগ্যাহত শিশু নারী কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে পরি। তাদেরকে কাজের বুয়া, চাকর হিসেবে না দেখে পরিবারের সদস্য হিসেবে কাছে টেনে নিতে পারি। মানুষ মানুষের জন্য এ তত্ত্বকথা আমাদের অন্তরের গভীরে ধারণ করে সাধ্যানুযায়ী তাদের পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গৃহকর্মী শিশু হলে পড়ালেখা শেখানোর মাধ্যমে তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

ধনী এবং শিক্ষিত পরিবারের অধীনস্থ গৃহকর্মীদের সাথে সদাচরণ করা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। দু:খের বিষয় ইদানীং গৃহকর্মীর ওপর অমানবিক নির্যাতন দিনদিন বেড়েই চলেছে। গৃহকর্মীদের দারিদ্রতার সুযোগে সমাজের ছোটো একটা অংশ তাদের ওপর বর্বরতা চালায় যার লজ্জা ভার জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। আমরা ভুলে যাই গৃহকর্মীদের সেবা সহযোগিতার কথা। আমাদের সংবিধানের ১৪,১৫,১৭,১৮,২৮,৩৪ ও৩৬ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গৃহকর্মীদের অধিকারের উল্লেখ থাকলেও গৃহ কর্মীদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা মানা হচ্ছেনা। দেশের মাটিতে গৃহকর্মী নিগৃহীত হওয়ার পাশাপাশি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নারী গৃহকর্মী পাঠানো হয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। যাচাই বাছাই না করে বিদেশে গৃহকর্মী প্রেরণের বিষয়টি অনেক মহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারী শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কাজেই সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এসব দেশে নারী শ্রমিক পাঠানো উচিত হবে না। সরকারী পর্যায়ে এক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অনেক সময় বাড়ির কর্তা ব্যক্তিরাও গৃহকর্মীর দ্বারা চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন সহ নানাবিধ হয়রানির শিকার হয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিচিতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। নিজেদের অসতর্কতা যেন আমাদের আত্মরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্তরায় না হয়। নেতিবাচক দিকগুলো ছাড়া পরিবার বা গৃহের আবশ্যকীয় কার্যাদি সম্পন্ন করার মাধ্যমে গৃহকর্মীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজেই গৃহকর্মে নিয়োজিত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় এবং কল্যাণে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত গৃহকর্মী সম্পর্কীত কনভেনশন ১৮৯ সমর্থনের লক্ষ্য ও প্রেক্ষাপট বিচারে বাংলাদেশেও এ নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ নীতির আলোকে গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের কাজের শর্ত ও নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, পরিবারসহ সর্বত্র মর্যাদার সাথে জীবনযাপন উপযোগী মজুরি কল্যাণ, নিয়োগকারী ও গৃহকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনে প্রকৃষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। এ নীতির আলোকে সংবিধানে ঘোষিত সম অধিকার ও সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চত করণ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে গৃহকর্মী নির্যাতন নয়, তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে ভাবতে হবে আমাদেরকে

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ এবং বর্তমানে রেক্টর, বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ, মিরপুর১৩, ঢাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএডভোকেট সাইফুল হত্যার বদলা আইনীভাবে নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা