স্বাধীনতা উত্তরকালে পপ গান বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে দারুণ সাড়া জাগায়। আর এক্ষেত্রে মূল কারিগর ছিলেন আজম খান। নতুন একটি দেশ– যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে গান গেয়ে বিপথগামী তরুণদের স্বপ্ন দেখতে থাকে। আজম খানের গান তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং স্বাধীন দেশে গান গেয়ে শুরু করেন আরেক যুদ্ধ।
মিলু আমান ও হক ফারুক–এর সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে “গুরু আজম খান” শিরোনামে একটি বই। মুখবন্ধে তাঁরা লিখেছেন: “কিংবদন্তি এই শিল্পীকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা সবাই গুণমুগ্ধ। স্টেইজে দেখা যেতো অন্য এক আজম খানকে। বাস্তবের আজম খানের সাথে যেন কোন মিল নেই। উনার জীবনযাপন ছিলো খুব সাধারণ, মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। এইসব টুকরো ইতিহাস নিয়ে এক মলাটে “গুরু আজম খান”। স্মৃতির পাতায় উঠে এসেছে আজম খানের চিন্তা–চেতনা, জীবন দর্শন। গল্প আকারে তুলে ধরেছি তাঁর অমূল্য কিছু সময়।”
বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে আজম খান অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, কাছ থেকেই দেখেছেন–তাঁদের লেখনীতে আমরা জানতে পারি গুরু আজম খানকে।
এই বইতে লিখেছেন : ফেরদৌস ওয়াহিদ (আমার বন্ধু আজম), রকেট (আমার গুরু, আজম ভাই), মাকসুদুল হক (মনে পড়ে তোমায়), ফোয়াদ নাসের বাবু( যতদিন বাংলা গান, ততদিন আজম খান), লাবু রহমান (আজম খান আমার মিউজিক স্কুল), আশিকউজ্জামান টুলু (প্রিয় আজম ভাই), জাহীদ রেজা নূর ( সেই সব দিনগুলি), কাজী ফায়সাল আহমেদ (এবার যুদ্ধে নামবো তোদের নিয়ে), মাহমুদ মানজুর ( পপগুরু মূলত শিশু!), এরশাদুল হক টিংকু ( গুরুর বয়ানে), কবীর সুমনের সাথে আজম খান ( বন্ধু কী খবর বল), হক ফারুক ( জনযোদ্ধা থেকে সুরযোদ্ধা), মিলু আমান (আজম খান একটা বিপ্লবের নাম)। এছাড়াও সংযুক্ত করা হয়েছে ডিস্কোগ্রাফি।
ফেরদৌস ওয়াহিদ লিখেছেন: “আজম খান কখনোই খুব উচ্ছ্বাস দেখাতো না, হইহুল্লোড় করতো না। মৃদুভাষী মানুষ। আজম খানের প্রথম রেকর্ড প্রথম যেদিন বাজারে আসলো সেদিনও ফোনকল আসলো আমার কাছে। আমি তাৎক্ষণিক আজমকে ফোন করে জানালাম, তোর রেকর্ড কিন্তু আজকে বাজারে গেছে। তখনকার দিনে এক হাজার রেকর্ড বিক্রি হলেই হিট বলা হতো। আজম খানের রেকর্ড সুপার ডুপার হিট হলো। হাজার হাজার কপি বিক্রি হলো। বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে উদিত হলো নতুন এক তারা। যে আসলো পপের ধ্যানধারণায়, রকের গুরু। শুরু হলো আজম খানের নতুন এক যাত্রা।”
আজম খানকে তাঁর ভক্তকুল “গুরু” নামে ডাকেন ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায়। এই “গুরু” নামে প্রথম ডাকেন আজম খানের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা ও লিড গিটারিস্ট রকেট। তিনি লিখেছেন: আজম ভাইকে প্রথম অবস্থায় আমিই ‘গুরু! গুরু!’ বলে ডাকা শুরু করেছিলাম। তিনি খুব বিরক্ত হতেন। আজম ভাই বলতেন, ‘এই ধুর! এইগুলো কি কও তুমি? আজম ভাই কইবা, না হলে আসবাই না এখানে!’ অনেক বকতেন। তারপরেও আমি ‘গুরু’–ই বলবো। এরপর এমন অবস্থা হয়, আজম ভাই যেখানেই যান উনাকে দেখলে সবাই ‘গুরু’ বলে ডাকা শুরু করে। পরে সেটা উনার সয়ে যায়।’
আজম খানের তুমুল একটি জনপ্রিয় গান “সারা রাত জেগে জেগে, কত কথা আমি ভাবি, পাপড়ি কেন বোঝে না, তাই ঘুম আসে না”। এই “পাপড়ি” কে? এনিয়ে আগ্রহ ভক্তকুলের। অনেক বছর পর আইয়ুব বাচ্চুর সাথে R Music অনুষ্ঠানে আজম খান পাপড়ি সম্পর্কে জানালেন। আজম খানের ভালোবাসা। কিন্তু শুভ পরিণয় হলো না। গানটি পাপড়িকে নিয়ে লেখা। রকেট–ও বললেন এই বিষয়ে। কুমিল্লায় শো করতে গিয়েছেন। সিনেমা হলে শো। তিনি লিখেছেন: “আজম ভাই বললেন, চলো ‘সারারাত’ গানটা গাই এবার। গানটার মুখটা গাওয়ার পর যখন আমি গিটার পার্টটা বাজাচ্ছিলাম, হঠাৎ আজম ভাই আমার কাছে এসে কানের কাছে হাত রেখে বলেন, রকেট, ভালো করে বাজাও, পাপড়ি তো এসে পড়েছে। আমি লিড বাজাতে বাজাতে স্টেজের সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। আজম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়? আজম ভাই বললেন, তিন নাম্বার রো–তে দেখো, সাদা শাড়ি পরে বসে আছে! আমার গিটারের জ্যাক বড়ো। আমি একদম স্টেজের সামনে চলে গেলাম। সামনে গিয়ে ভালোমতো দেখলাম, হ্যাঁ সে বসে আছে। এদিকে আজম ভাই গানের শেষটুকু গাইলো, তাঁর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতেছিল। তিনি খুব আবেগ দিয়ে গানটা গেয়েছিলেন। সেইদিনের ঘটনা কোনো সিনেমার থেকে কম ছিল না।”
মাকসুদুল হক লিখেছেন: “বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে আজম খানের মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত। উনার অবদান যে অসীম এতে কোন সন্দেহ নাই। রাষ্ট্র উনাকে দিয়েছে সংগীতের জন্য একুশে পদক। ব্যান্ড সংগীতে আজম খানের আবির্ভাব, সংগীতে উনার অবদান, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজম খান ; এসবই অকল্পনীয় এবং অনস্বীকার্য। আজম খানের গানগুলো কপিরাইট করা উচিত।”
ফোয়াদ নাসের বাবু লিখেছেন: “আজম ভাইয়ের রসবোধ, ঠাট্টা–তামাশার আড়ালে পেছনের মানুষটার ছিল প্রগাঢ় জীবন ও গভীর মমত্ববোধ। তাঁর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ–সামাজিক ভাবনা ও উপলব্ধি ছিল ভীষণ গভীর। বিশেষ করে তাঁর কিছু গানের কথায় এই সব বিষয় ছবির মতো উপস্থাপিত হয়েছে।… প্রাগসর দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই তিনি তরুণ সমাজের কাছে হয়ে উঠেন একজন অবিসংবাদিত গুরু। ”
লাবু রহমান। যিনি আজম খানের সাথে গিটার বাজিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: “আজম ভাই যেমন ছিলেন বড়ো মনের মানুষ, তেমনই সংগীতের জন্য নিবেদিত একজন। আমার গিটার বাজানো তিনি খুবই পছন্দ করতেন। তাই তাঁর জন্য নতুন কিছু সৃষ্টির উদ্দীপনাও কাজ করতো। সেসময় আমি একটি গান কম্পোজ করলাম। করার পর মনে হলো, এটা আজম ভাই গাইলে ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যাবে। এই ভেবেই একদিন আজম ভাইকে বললাম, আমার একটা গান আছে, আপনি গাইবেন কিনা? তিনি শোনাতে বললেন। তিনি গানটা সহজেই তাঁর কণ্ঠে তুলে নিলেন। সেই গানটি হলো, ‘আমি যারে চাইরে, সে থাকে মোর এ অন্তরে… ।’
আজম ভাইয়ের স্টুডিয়ো রেকর্ড করা অনেকগুলো গানের গিটার আমার বাজানো। তিনি রেকর্ডিং সেশন হলেই আমাকে ডাক দিতেন। ‘বাংলাদেশ’ গানটির শুরুতে গিটারে যে কাজগুলো, সেগুলো আমারই কম্পোজ করা। আমার জীবনে আজম ভাই আসলে এক মিউজিক স্কুল। ”
আশিকউজ্জামান টুলুও আজম খানের কাছে ঋণী। তিনিও লিখেছেন: “আজম ভাইয়ের কাছে আমি দুইটা বিষয় শিখেছি–প্রথমটা, বাংলায় রক মিউজিক কীভাবে হতে পারে, দ্বিতীয়টা প্রেম! পৃথিবীর প্রতিটা মানবিক পদক্ষেপে প্রেম বিষয়টা যে কি, তা আজম ভাইয়ের গানে, কথা বলায়, আচরণে শিখে নিয়েছি।”
জাহিদ রেজা নূর লিখেছেন : “আমাদের দেশে নাট্যচর্চাকে সবাই বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের সেরা ফসল। কিন্তু এ কথা বলার সময় ব্যান্ড সংগীতকেও (তখন তো বলা হতো পপ সংগীত) মাথায় রাখা দরকার। একদল তরুণ এ সময় নিজেদের প্রকাশের পথ দেখেছিলেন গানের মাধ্যমেই। কোন সন্দেহ নেই, আজম খান তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা।”
এভাবেই আজম খানকে আমরা জানতে পারি। একজন সংগীত শিল্পী হয়ে ওঠা আর চর্চা করে আমৃত্যু গানের সাথেই যুক্ত থাকা, এদেশে খুব কম আছে। কবীর সুমনের সাথে সাক্ষাৎকার পর্বটিও গুরুত্ব রাখে। এ এক আরেক আজম খান। কবীর সুমন তাঁকে দেখেছেন সাধারণের মাঝে অসাধারণ সংগীতশিল্পী হিসেবে।
আজব প্রকাশ থেকে প্রকাশিত “গুরু আজম খান” বইটি নিঃসন্দেহে সংগ্রহ করে রাখার মত একটি বই। অন্তত যারা আজম খানকে ভালোবাসেন।