দেশের শস্যভাণ্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে এখন চলছে ধানের উৎসব। দেড়শ’ কোটি টাকারও বেশি আমন ধান উৎপাদন হয়েছে এবার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষাবাদ ও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলনে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিলের পঞ্চাশ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধানও কাটার প্রক্রিয়া চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের খাদ্য উদ্বৃত্ত উপজেলা হিসেবে রাঙ্গুনিয়ার সুনাম রয়েছে। এখানে রয়েছে দেশের শস্যভাণ্ডার খ্যাত দ্বিতীয় বৃহৎ বিল, যা গুমাই বিল হিসেবে পরিচিত। রাঙ্গুনিয়ার ছয়টি ইউনিয়নের পাশ ধরে বিস্তৃত সাড়ে সাত হাজার একরের গুমাই বিলে প্রচুর ফসল উৎপাদন হয়। আমন এবং বোরো চাষের মাধ্যমে ছয়টি ইউনিয়নের পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক পুরো বছরের খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রচুর ধান বিক্রিও করা হয়।
তিনি আরো বলেন, এক সময় বলা হতো, গুমাই বিলে এক মৌসুমে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তা দিয়ে পুরো দেশের অন্তত আড়াই দিনের খাবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে গুমাই বিলের ফসল দিয়ে পুরো দেশের আড়াই দিনের খাবার না হলেও অন্তত এক দিনের খাবারের যোগান দেয়া সম্ভব। দেশে দৈনিক অন্তত প্রায় ৬০ হাজার টনের মতো খাদ্য শস্যের চাহিদা রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে গুমাই বিল থেকে ৫৫ হাজার টনের বেশি ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাঙ্গুনিয়া কৃষি কর্মকর্তা কারিমা আকতার গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, গুমাই বিলে এবার ১৪ হাজার ৯১০ হেক্টর বা ৩৫ হাজার ৭৮৪ একর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু চাষাবাদ শেষে দেখা যায় যে, কৃষকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই হাজার একর বেশি জমিতে আমন চাষ করেছেন। গুমাই বিলে এবার আমন চাষ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৩১০ হেক্টর বা ৩৭ হাজার ৮১৫ একর জমিতে। আমনের শুরু থেকে দারুণ আবহাওয়া ছিল উল্লেখ করে কারিমা আকতার বলেন, পুরো সময়টাতেই চমৎকার আবহাওয়া ছিল। তবে শেষদিকে এসে কিছু ঝড়ঝাপ্টা হলেও তা ফসলের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। এতে করে আমাদের ফসল উৎপাদনও প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিলের পঞ্চাশ শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। বাকি ফসলও কাটার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা ফসল মেপেছি। ধারণার চেয়ে বেশি ফলন হয়েছে। তিনি গুমাই বিলে এবার হেক্টর প্রতি ৩.৫ টন হিসেবে ৫৫ হাজার টনের মতো ফসল উৎপাদিত হবে বলে জানান। উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবহার, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের সচেতনতার কারণে ফলনের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, সরকার প্রতি কেজি চিকন ধান ৩০ টাকা এবং মোটা ধান ২৪ টাকা ক্রয়মূল্য ঘোষণা করেছে। গুমাই বিলে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক চিকন এবং অর্ধেক মোটা হিসেব করলেও ৫৫ হাজার টনের বাজারমূল্য দেড়শ’ কোটি টাকা ছুঁয়ে যায় বলে সূত্র জানিয়েছে।
গুমাই বিলের চারা বটতল, কদমতলী, লিচু বাগানসহ বিলের বিভিন্ন এলাকায় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে গতকাল একাধিক কৃষক দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, ফলন অনেক ভালো হয়েছে। সোনারাঙ্গা ধানে হাসছে গুমাইবিল। তবে টিয়া পাখির উপদ্রব বেড়েছে। প্রচুর ধান খেয়ে ফেলছে। মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন নামে একজন কৃষক দৈনিক আজাদীকে বলেন, অত্যন্ত ভালো ফলন হয়েছে। আমরা ফসলও কেটে ফেলেছি। ধারণার চেয়ে বেশি ফলন হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কানিতে ১০০ আড়ি পর্যন্ত ধান পাচ্ছি। আমাদের আশা ছিল ৮০ আড়ি পর্যন্ত পাব। ধারণার চেয়ে বেশি ফলন হওয়ায় কৃষকরা অত্যন্ত আনন্দিত বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চাষাবাদে প্রচুর খরচ। এভাবে ফলন হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন। যা ভবিষ্যতে কৃষিখাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাবেদ হোসেন বলেন, কৃষকরা চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশের কৃষি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গুমাই বিলের বাড়তি ফলন কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কারিমা আক্তার বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলন হয়েছে। আমাদের কৃষক ভাইয়েরা অনেক খুশি। খাদ্য উদ্বৃত্ত উপজেলা হিসেবে রাঙ্গুনিয়ার ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, শুধু গুমাই বিলেই নয়; এবার পুরো চট্টগ্রামে আমনের ভালো ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষ করা হয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এবার ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছে। গতবছর আবাদ করা হয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৬৯৪ হেক্টর। চট্টগ্রামে এবার হাইব্রিড চাষ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৮৫ হেক্টর, উফশী ১ লাখ ৫১ হাজার ২৩৫ হেক্টর ও স্থানীয় ধান আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে। গুমাই বিলের ধান প্রায় অর্ধেক কাটা হলেও চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে এর পরিমাণ ২০ শতাংশের মতো। আবহাওয়া অনুকূল এবং উন্নত প্রজাতি ও প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।