ভারতের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত গুজরাট এমন এক রাজ্য যা একই সাথে প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন। ইতিহাস, নৃত্য, খাদ্য, উৎসব, দর্শনীয় স্থান সবকিছুরই এক অনন্য সমাহার এখানে। একটানা ভ্রমণ করলে দেখা যাবে, শহর থেকে গ্রাম প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো গল্প, কোনো না কোনো সৌন্দর্য, যা একবার দেখলে মনে গেঁথে যায় সারাজীবনের জন্য।
গুজরাটের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই বিস্ময়কর। হাজার বছরের পুরনো সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন বহন করে চলেছে লোথাল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে জানা যায়, এখানে ছিল উন্নত ড্রেনেজ সিস্টেম, পরিকল্পিত নগরী আর এক সময়কার সমৃদ্ধ নৌবাণিজ্য। আহমেদাবাদের সিদ্দি সাঈদ মসজিদের ঝালরকাটা জানালার কাজ আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহ্য শহর আহমেদাবাদের পুরোনো পোল এলাকায় হাঁটলে মনে হয় আপনি ইতিহাসের পাতার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। গির ন্যাশনাল পার্কে গেলে প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়ের দেখা মেলে এখানেই বিশ্বের একমাত্র এশিয়াটিক সিংহের বসবাস। সোমনাথ মন্দিরের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে যখন সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনবেন, মনে হবে ইতিহাসের সাথে প্রকৃতি নিজেই কথা বলছে। আরও আছে দ্বারকা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের চিহ্ন আজও মানুষের বিশ্বাসে অটুট, আর আছে পাটন, যার রাণী কি ভাভ প্রাচীন স্টেপওয়েল স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন।
গুজরাট শহর খাবারের বৈচিত্র্য আর স্বাদের জন্য সমগ্র ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ। এখানকার গুজরাটি থালি যেন এক শিল্পকর্ম একসাথে পরিবেশন হয় কড়ি, ডাল, শাক, ভাত, রোটলো, পাপড়, আচার আর শেষে মিষ্টি। বিশেষত ধোকলা, খাণ্ডভি, হান্ডভো, সেভ খামানি, থেপলা এই সব পদ গুজরাটের বৈশিষ্ট্য। সকালের নাশতায় ফাফড়ার সাথে গরম জিলাপির মেলবন্ধন স্বাদের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি তৈরি করে। শুধু খাবারের স্বাদ নয়, এখানে খাবারের পরিবেশন আর অতিথিপরায়ণতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। কোনো গুজরাটি বাড়িতে একবার অতিথি হয়ে গেলে বুঝবেন “অতিথি দেবো ভব” এখানে কেবল একটি কথা নয়, জীবনের অংশ।
গুজরাটের আসল প্রাণ লুকিয়ে আছে তার নৃত্য ও উৎসবে। নবরাত্রির সময় গুজরাটের প্রতিটি শহর, ্র প্রতিটি গ্রাম যেন রঙিন আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। রাতের পর রাত ধরে চলে গরবা আর ডান্ডিয়ার আসর। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে হাতে কাঠির ঠুকঠাক শব্দে আর পায়ের নূপুরের ছন্দে তৈরি হয় এক অনন্য মাদকতা। গরবা কেবল একটি নৃত্য নয় এটি মাতৃশক্তির আরাধনা, এটি এক সামাজিক মিলনমেলা। এখানে অংশগ্রহণ করে গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে শহরের তরুণ–তরুণী সবার মুখে থাকে প্রাণভরা হাসি, সবার চোখে আনন্দের ঝিলিক। ডান্ডিয়ার দ্রুত তালে যখন নাচ চলে, তখন মনে হয় যেন সারা রাজ্য একসাথে নেচে উঠেছে।
গুজরাটের গ্রামীণ জীবন যেমন সরল, তেমনই সংস্কৃতিতে ভরপুর। কচ্ছ অঞ্চলের রঙিন কাঁথা সেলাই, বাঁধনী কাপড়, কাঠের খেলনা, হস্তনির্মিত গয়না সবকিছুতেই ঝলমল করে গুজরাটের শিল্পসৌন্দর্য। গ্রামে গেলে স্থানীয় মানুষের আন্তরিকতা আপনাকে স্পর্শ করবে। তারা আপনাকে ঘরে নিয়ে যাবে, গরম থেপলা খাওয়াবে, আর গল্পে গল্পে জানিয়ে দেবে তাদের জীবনের কথা। গুজরাটের উৎসবগুলোও চোখ ধাঁধানো ঘুড়ি উৎসবের আকাশভরা রঙিন ঘুড়ি, রান উৎসবের মরুভূমির সাংস্কৃতিক আসর, আন্তর্জাতিক ঘুড়ি প্রতিযোগিতা সবই এখানে একের পর এক রঙিন অধ্যায় যোগ করে।
গুজরাট কেবল একটি রাজ্য নয়, এটি যেন ভারতের সংস্কৃতির এক জীবন্ত ক্যানভাস। এখানে আছে অতীতের ইতিহাস, বর্তমানের প্র্রাণোচ্ছ্বলতা আর ভবিষ্যতের অদম্য সম্ভাবনা। একবার গুজরাটে গিয়ে এই রাজ্যের স্পন্দন অনুভব করলে দেখবেন আপনার হৃদয়, ইন্দ্রিয় আর রসনা সবই একসাথে আন্দোলিত হয়ে উঠছে।