গিটার তাঁকে ঘরছাড়া করেছিল

নাজমুস সাকিব রহমান | সোমবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

‘আমার চাতক চোখে তুমি হবে দূরের আকাশ’

চার দশকের ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার। দেখেছেন সাফল্যের চূড়ান্ত। অডিও ইন্ড্রাস্ট্রির উত্থান-পতন। এই দীর্ঘ সময়ে বদলেছে অনেককিছুই। কিন্তু বদলায়নি জেমসের গান; আর তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা। এখনো তিনি যখন মঞ্চে উঠেন তাকে যতটা কাছের মনে হয়, মঞ্চ ছাড়তেই হয়ে যান ততটা দূরের।

ক্যাসেট, সিডি, এমপি থ্রি হয়ে স্পটিফাইকত রূপ দেখতে হলো তাকে। তবুও এখনো তার কনসার্টে জেগে ওঠে ভালোবাসার উদ্দীপনা। বিরহে নামে পদ্মপাতার জল। বোহেমিয়ান জীবন, খ্যাতি, প্রেম, বিচ্ছেদ-সবই আছে তার জীবনে। এসব নিয়েই তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মঞ্চ তারকা হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন।

‘ছোটাও রেসের ঘোড়া, হারজিৎ পরে হবে’

এই অক্টোবরই জেমস্‌ের জন্মমাস। ৫৮তে পা দিলেন তিনি। জন্মেছিলেন নওগাঁয়। আর শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। তার পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলের গায়কজীবন চাননি বাবা ড. মোজাম্মেল হক আর মা জাহানারা খাতুন। এরপর অভিমানী ছেলেকে নিতে হয় কঠিন সিদ্ধান্ত।
ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন জেমস্‌। সেই সময় তার ঠিকানা হয় চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকার আজিজ বোর্ডিংয়ে। ‘১২ বাই ১২’র একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন তিনি। বোর্ডিংয়ের সামনের এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া আর সন্ধ্যায় হোটেল আগ্রাবাদের নাইট ক্লাবে মার্ক নফলার, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, জিম মরিসন বা বব মার্লেও কোনো গান।

‘চোখের বোরখা নামিয়ে দেখো জোছনার গালিচা’

আজিজ বোর্ডিং নিয়ে এখনও স্মৃতিকাতর হন জেমস্‌। অনেকবারই তিনি বলেছেন, ‘গানের টানে, প্রাণের টানেই ঠাঁই হয়েছিল সেখানে। গান, আড্ডা আর যা-ই হোক না কেন সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনও ভুলব না।’
ভাগ্যিস, ঘর ছেড়েছিলেন। না হলে কী প্রেমিকার কাছ থেকে চিঠি এসেছে বলে যমদূতকে ফিরিয়ে দেওয়া যেত? অথবা গ্রাম-বাঙলার গল্প উঠে আসতো বাঙলা ব্যান্ড গানের শরীরে? কি হতো ‘হারাগাছের নূরজাহান’, ‘বাঙলার লাঠিয়াল’, ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’, ‘যাত্রা’, ‘গাঁয়ের খবর’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘হাউজি,’ ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না’র মতো গানগুলোর?

‘কথার কুসুম ছড়িয়ে দিয়েছি ক্যাফেটেরিয়ার কোণে’

আবু মুসা চৌধুরী, আসিফ ইকবাল, লতিফুল ইসলাম শিবলী, বাপ্পী খান, আসাদুল্লাহ দেহলভী, মারজুক রাসেল, আনন্দ, সুমন, বিশু শিকদার, গোলাম মোরশেদ, নিয়াজ আহমেদ অংশু, সাকী আহমেদ, রাজীব আহমেদ, তরুণ মুনশীর মতো কবি-গীতিকবিরা তাদের সবচেয়ে ভালো লিরিকগুলো লিখেছেন তার জন্য। ফলে জেমস্‌ের গান শুধু সুরনির্ভর নয়, কাব্যনির্ভরও।
গানের জন্য কবিতার কাছে শরণাপন্ন হতেও ভোলেননি জেমস্‌। কবি শামসুর রাহমানের রোমান্টিক পটবয়লার ‘উত্তর’-এর ফিলিংস ভার্সন ‘তারায় তারায়’ সেই শরণাপন্ন হওয়ার একটি উদাহরণ। আর তা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এর আগে করেছিলেন লতিফুল ইসলাম শিবলীর ‘প্রিয় আকাশী’। একটি চিঠিকে গানে পরিণত করেছিলেন জেমস্‌।

‘ফুল শুধু ছড়াবে সৌরভ, লজ্জায় বলবে না কিছু’
আশির দশকে ফিলিংসের সঙ্গে যুক্ত হন জেমস্‌। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম ‘ষ্টেশন রোড’। পরের বছরই হাজির হন একক অ্যালবাম নিয়ে। ‘অনন্যা’ নামের সেই অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা পায় সঙ্গে সঙ্গেই। যদিও ডেব্যুর সবগুলো গানই ছিল ইংরেজি গানের সুর।
এরপর ‘জেল থেকে বলছি’ (১৯৯৩), ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬) ও ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮)। এই তিনটি অ্যালবামের পর ভেঙে যায় ফিলিংস। ছন্দ হারায় ফান্টি-জেমস্‌-আসাদের কিংবদন্তী বোঝাপড়া। তিনি গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড ‘নগর বাউল’।
তবে এই ব্যান্ড আটকে যায় প্রথম অ্যালবামেই। ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১) নামে একটি অ্যালবামের পর নগর বাউলের গান আর বেরোয়নি।

‘তর্জনী উঁচিয়ে জ্বেলে দেব সবুজ আগুন’

ওদিকে জেমস্‌ের একক অ্যালবামের সংখ্যাও কম নয়। অনন্যা’র পর একে একে বেরিয়েছে ‘পালাবি কোথায়’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৬) ও ‘কাল যমুনা’ (২০০৯)। এছাড়া অজস্র মিক্সড অ্যালবামে রয়েছে তার গান। সব মিলিয়েই নাইট ক্লাব থেকে মাঠে-ঘাটে পৌঁছেছেন তিনি। আর এ নিয়ে আছে জেমস্‌ের স্ট্রেটকাট ভাষ্য।
তিনি বলেছেন, ‘এক জীবনে অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে! এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এটাও ঠিক, এই ভালোবাসা পাওয়ার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। অনেক ওঠানামা ছিল। কিন্তু হাল ছাড়িনি। গান করেছি, এটাই ছিল আমার আনন্দ, এটাই ছিল আমার ভালো লাগা-ভালোবাসা। তারপর কী হয়েছে, না হয়েছে তা নিয়ে ভাবিনি। কিছু না হলেও গানই গাইতাম।’

‘চুড়ি ফিতা রঙিন সুতা রঙিন করিবে মন’

প্রিন্স মাহমুদ, জুয়েল-বাবু, শউকত বা প্রীতমের মতো সংগীত পরিচালকদের চাহিদার শীর্ষে ছিলেন জেমস্‌। ২০০৫ সালে বলিউডে যখন ‘ভিগি ভিগি’ গানটি প্রকাশিত হয়, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন মুম্বাইতে স্থায়ী হবেন তিনি। কিন্তু তিনি জানতেন, গণমানুষের গান করতে চেয়েছিলেন সারাজীবন। তাই ফিরে এসেছেন। নিজ দেশে, নিজ শর্তে জীবন কাটাতে।
জেমস্‌ তো বলেই দিয়েছেন, ‘আমি গণমানুষের গান গেয়েছি আজীবন। আমার জীবন দর্শন, আবেগ অনুভূতি, তরুণদের উৎসাহ দেওয়া, দেশপ্রেমের কথা বলা- সবই এনেছি গানের ভেতর।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিনেমার দার্শনিক জাঁ লুক গদার
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় নতুন শনাক্ত ২৫