বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব অনেকটা ধূমকেতুর মতো। মূলত নজরুল অল্প সময়েই কালজয়ী কবিতা, অসামান্য গান, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন গল্প, স্বাধিকারবোধের নাটক, জীবন খেয়ালি উপন্যাস, সাহিত্যকৃতি জাগরণের প্রবন্ধ রচনা করে সর্বত্র ফেলে দিয়েছিলেন দারুণ হৈচৈ।
প্রতিভাধর নজরুল অনুপম সৃজন শৈলীতে নিমগ্ন হওয়ার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২২ বছর। কিন্তু এত অল্প সময়ে আপামর বাঙালিকে যে সম্পদ উপহার দিলেন তা আজও এক অনন্য সৃষ্টি সম্ভার। দাপটের সঙ্গে সৃজন সৌধকে অবারিত করতে সমকালীন সার্বিক ধারাকে যেভাবে অতিক্রম করলেন তাও এক অসাধারণ সৃষ্টির উন্মাদনা। নিজেকে যথার্থ আসনে বসানোই শুধু নয়, উপস্থিত সময়েরও তিনি এক নান্দনিক দ্যোতনা। যা কাল ও যুগের সীমানা অতিক্রম করে আজও সবাইকে উদ্দীপ্ত চেতনায় মাতিয়ে রেখেছে।
অতুলনীয় সংগীত সম্ভার উপহার দেওয়া নজরুল বাংলা গানেরও ব্যতিক্রমী ধারার দিক্পাল। রাগ–রাগিণীর সুরঝঙ্কারে সংগীতকে যে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেলেন, সেখানেও তিনি তুলনাহীন। বাংলা গানের ভারে অজেয় প্রাণপুরুষ তো বটেই কবি, সংগীতজ্ঞ নজরুল প্রকাশ মাধ্যমের আঙিনাকেও যেভাবে ভরিয়ে তোলেন, সেটাও তার অনবদ্য মনন সাধনা। নজরুলের সাহিত্যকাল ২২ বছর সেখানে সংগীতকাল মাত্র ১৬ বছরের। নজরুল লেটোর দলে সনাতন পৌরাণিক কাহিনি, সৈন্যদলে আরবি, ফার্সি, উর্দু গজল রাগসংগীতের সংস্পর্শে আসেন। অপার আগ্রহ ও বিস্ময় বোধের অধিকারী নজরুলের শেখার ক্ষমতা ছিল ঈর্ষণীয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে দেশ–উদ্দীপক কবিতা গানে মনোনিবেশ করেন। অতি অল্প সময়ে জাগরণীমূলক গান লিখে সুর করে গেয়ে বাংলা গণসংগীতের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। তিনি যেমন জলসায় গান করেছেন, তেমনি সভায়, মিছিলে, গান করে নতুন ধারা তৈরি করেন।
নজরুলের সামপ্রদায়িকতাবিরোধী স্বদেশি গান, ‘দুর্গম গিরি কান্তার–মরু’ ১৯২২ সালে কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রথম পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়। নজরুল গানে লোকসুর যেমন ব্যবহার করেছেন, একইভাবে রাগাশ্রীয় সুর, কখনো মিশ্র রাগ, খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরি ব্যবহার করেছেন। আবার বিদেশি সুর চমৎকারভাবে আত্মীকরণ করে নিজস্ব আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন। পৌরাণিক কাহিনির দুই শক্তিশালী চরিত্র কৃষ্ণ ও কালী উভয়কে নিয়ে নজরুল গীত রচনা করেছেন। তাঁর গানে রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা উঠে এসেছে। আবার এসেছে শ্যামা, উমা, সতী, সীতার দুঃখ বেদনা, শিবের ক্রোধ, তাণ্ডবলীলা ইত্যাদি। রক্তজবা গ্রন্থে প্রকাশিত গানে শ্যামা মায়ের প্রতি ভক্তের আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য গান ‘শ্যামা তোর নাম যার জপমালা’। বৈষ্ণবপদাবলির উল্লেখযোগ্য গান ‘তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম’, ‘ বৃন্দাবনে একি বাঁশরী বাজে’। নজরুল এক রাগের সঙ্গে আরেক রাগের মিলনে নতুন রাগ তৈরি করে বাংলা সংগীতের সৌন্দর্যের বৃদ্ধি করেছেন। শিব–পার্বতী ও রাধা–কৃষ্ণ যুগলদয়ের যুগপৎ ধারণে ভৈরব ও আহিরী রাগ দুটি একত্রে আহির–ভৈরব রাগে সৃষ্টি করেছেন ‘অরুন কান্তি কে গো যোগী ভিখারী’ শীর্ষক খেয়ালে। রাগরাগিনীর সুরের খেলায় নজরুল যেসব গান সৃষ্টি করে গেছেন তা বাঙালির কানে আরামদায়ক স্বস্তির অনুভূতি এনে দিয়েছে।
যেমন বৈষ্ণব সমপ্রদায়ের জন্য লিখেছেন, তেমনি ইসলামী সংগীত লিখেছেন। ইসলামি গান বা গজলে বাংলা সংগীতে শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ কাজী নজরুল। স্বপনে প্রেমিক দেখা দিয়ে চলে গেছে, জেগে উঠে প্রেমিকার পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ চমৎকার দৃশ্যকল্পে ফুটে উঠেছে নজরুলের ‘চোখের চাতক’ গ্রন্থে ভৈরবী–দাদরা রাগে সৃজিত প্রেমের গজল ‘মোর ঘুম ঘোরে কে এলে মনোহর, নমো নম নামো নম নমো নম’। আবার একই গ্রন্থের অন্য একটি জনপ্রিয় গানে নজরুল পেছনের ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে সুন্দর ছবি এঁকেছেন। কেউ অতীতের স্মৃতি ভুলে থাকে, কেউ অতীতের দুঃখে কাঁদে। আবার কেউ অতীত ভুলে নতুন কুঞ্জ সাজায়। মানবিক সত্য বোধের এক অপূর্ব দৃশ্যকল্প পাওয়া যায় মান্দ–কাহারবা রাগে রচিত ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি’ এ গানে। আবার মানুষের ভাগ্য বিধাতার হাতে পূর্বেই সৃষ্ট–এই বার্তা শোনা যায় সিন্ধু কাফি–কাওয়ালি সুরে নজরুলের রচিত ওমর খৈয়াম গীতি নামক গানে ‘সৃজন–ভোরে প্রভু মোরে সৃজিলে গো প্রথম যবে, (তুমি) জানতে আমার ললাট–লেখা, জীবন আমার কেমন হবে’।
অপরদিকে, শিল্পী মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে, ‘আলগা কর গো খোপার বাঁধন/দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি/বিনোদ বেণীর জরিন ফিতায়/আন্ধা ইশক মেরা কাশ গায়ি’, কিংবা ‘আধো আধো বোল লাজে, বাধো বাধো বোল, বোল কানে কানে’। এসব গজল বাঙালির সংগীত তৃষ্ণা মিটায়ে পরিতৃপ্ত করেছে। নজরুলের তৈরি বাংলা গজল বাঙালি শ্রোতার কানে মধু ঢেলে দিয়েছে। কথা ও সুরে মায়া সৃষ্টি করে শ্রোতাকে বিমোহিত করে রাখে এমনি জলতরঙ্গের ধারা মান্দ–রাগে তৈরি ‘এত জল ও–কাজল–চোখে পাষাণী আনলে বল কে/টলমল জল–মোতির মালা দুলিছে ঝালর–পালকে’ গজলটি। ১৯২৫ সালে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল/আজো তার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি/তন্দ্রাতে বিলোল’। এ গজল দিয়ে শুরু করে নজরুল একে একে লিখেছে ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি/দাও গো সাকী দাও শারাব/ হায় সাকী এ আগুরী খুন/নয় ও হিয়ার খুন খারাব’, ‘কে বিদেশী বন–উদাসী/বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে/সুর–সোহাগে তন্দ্রা লাগে/কুসুম–বাগে গুল–বদনে’, ‘চেয়ো না সুনয়না/ আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/ জানিতে নাই ক বাকী/সই ও আঁখি কি যাদু জানে’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল/মলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল’সহ আরও অসংখ্য মনরাঙানো গজল। বাংলা প্রেমের গানে নজরুল অনবদ্য। নজরুল আধুনিক গানে রাগের সুর নিয়ে খেলা করেছেন বিরহের গজল রচনাতেও অপ্রতিদ্বন্দী। তাঁর কালজয়ী গান যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার অন্যতম সেরা প্রেমের কিছু গান ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেবো খোঁপার তারার ফুল’,। ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখো তারে’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’, ‘জনম জনম গেল আশা পথ চাহি, আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দিবো না ভুলিতে’, ‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে’।
এছাড়া ‘চোখের চাতক’ গ্রন্থে নদীর কূল ভাঙার সঙ্গে মন ভাঙার মনোরম তুলনা করে দেখিয়েছেন, নদীর কূল ভাঙলে চর জাগে কিন্তু হৃদয় ভাঙলে আর হৃদয়ে ভালোবাসার পলি জন্মে না। এই রূপছবি শ্রোতার মনে ভেসে ওঠে কাহারবা তালে রচিত, ‘আমার গহীন জলের নদী! আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি’–এই ভাটিয়ালি গান শুনে। ’বনগীতি‘ নামক গানের সংকলনে গ্রামীণ পরিবেশে নদী তীরে জল আনতে গেলে কিশোরী প্রেমিকার প্রেমিকের চোখে ধরা পড়ার লজ্জারাঙা আনন্দের অপূর্ব ছবি ফুটেছে ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা/নাচে তীরে খঞ্জনা/পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি/আমি যাবো না আর অঞ্জনাতে/জল আনিতে সখি লো/ঐ আঁখি কিছু রাখিবে না বাকী’ গানটিতে। আবার প্রিয়ার সঙ্গে এজন্মে আর দেখা হবে না–এই দুঃখে বিরহী প্রেমিকের কণ্ঠে যেন নজরুল পরজ–একতালা সুরে গেয়ে উঠলেন ‘চোখের চাতক’ গ্রন্থের ‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয়! ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও’ গানটি।
নতুন সুর সৃষ্টির জাদুকর কাজী নজরুল বিদেশি বিশেষত আরবি, তার্কি, ফার্সি সুরে গান রচনা করে বাংলা গানকে অনন্য উচ্চতায় উঠিয়েছেন। তিনি মিসরীয় নাচের সুরে তৈরি করেছেন, ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়’, আরবি সুরে লিখেছেন, ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম/ খেজুর পাতার নূপুর বাজায়ে কে যায়’। আবার কিউবান নৃত্যের তালে সুর দিয়েছেন ‘দূর দ্বীপ–বাসিনী, চিনি তোমারে চিনি/দারুচিনি দেশের তুমি বিদেশিনীগো, সুমন্দভাষিণী’। তিনি ইউরোপীয় অর্কেস্ট্রার সুরে তৈরি করেছেন, ‘খেলিছে জলদেবী, সুনীল সাগর জলে’।
ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই বেজে ওঠে ও মন রম্জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ …। এ গান যেন ঈদের খুশিকে দ্বিগুণ করে তোলে। আর রোজা শেষে এই গান যেন ঈদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছে।
গানটি বেজে উঠলেই ছেলে–বুড়ো সবার মন দুলে ওঠে আনন্দে। প্রায় একশো বছর ধরে বাঙালির ঈদ–আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানটি। এ গান বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের আঙিনায় বানের মতো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে স্মৃতির লহর।
ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনে, রেডিওতে বাজতে শুরু করে গানটি। এ গান ছাড়া রমজানের ঈদ আমাদের অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সত্যি বলতে কী, গানটি ছাড়া বাঙালির ঈদ–উল–ফিতরের কথা তো ভাবাই যায় না। এটি হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় ঈদ–সংগীত।
আপামর বাঙালির মননে গেঁথে যাওয়া এই গানটি কাজী নজরুল লিখেছিলেন জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের অনুরোধে, ১৯৩১ সালে।
প্রসঙ্গত,সরস্বতীর বরপুত্র কাজী নজরুল ইসলাম। যারপরনাই নজরুল ও তাঁর গানকে ভোলা বাঙালির জন্য অসম্ভব। কবিতা, গান সহ সুরস্রষ্টা নজরুলকে ভালোবেসে হৃদয়ে লালন করে সব বাংলাভাষী।
ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার