গানের নেপথ্যের কথা

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৩ at ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নদী এসে পথ সাগরে মিশে যেতে চায়

এই মিলন মেলা কে রুখে

ভালোবাসা এমনি সর্বনাম

ফিরে আসে আর হারায়

নদীর অচেনা বাঁকে….

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলসএর জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা এতটাই হৃদয়গ্রাহী, শোনা মাত্রই মন ও আবেগ অন্যরকম হয়ে যায়। আর সুরও অসাধারণ। সোলসএর প্রথম অডিও এলবাম ‘সুপার সোলস’এ গানটি রিলিজ হয়। সোলসএর মূল গায়ক তপন চৌধুরী গানটি গেয়েছেন। আমরা তখনও ইশকুলে পড়ি। জানতাম না এই গানটি কে লিখেছেনআর সুরই করেছেন কে?

অথচ আমরা বন্ধুরা মিলে গাইছি। ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনছি। এই গানটি সোলস তথা ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয় গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

অনেক বছর পর জানলাম এই গানটি লিখেছেন চিত্রশিল্পী ও কবি খালিদ আহসান। সুর করেছেন নকীব খান। তাঁরা দুইজনই আমাদের প্রজন্মের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। যা হোক, একটা সময়ে এসে খুব আগ্রহ হলোআমাদের তারুণ্য বেলার জনপ্রিয় গানগুলো লেখা ও সুর করার নেপথ্যের কথা জানতে হবে। তখন করোনাকাল চলছে। প্রায় সময় মোবাইল ফোনেই বিভিন্ন জনের সাথে আড্ডা হতো। এমনই এক সময়ে কবি খালিদ ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম এই গানের লেখা নেপথ্যের কথা।

খালিদ ভাই বললেন: “কোন বিশেষ কিছু নেই। এটি শাশ্বত প্রেমের গান। মানবমানবীর আবেগ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যেতে চায়। যেমনটা হয় নদী ও সাগরের ক্ষেত্রে। এই গানেও সেটাই বলেছি। ভালোবাসার রঙ, স্মৃতি রূপক অর্থে কিছু বিষয় উল্লেখ করেছি। আমাদের চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আছে নদী ও সাগরের মিলন। এই মোহনার জায়গাটি আমার খুবই প্রিয়। এখানে আসলে পর আমার এরকম অনুভূতি হয়। ধরে নাও, এমন ভাবনা থেকেও গানটি লেখা হয়েছে।”

খালিদ ভাই বলছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছি। আমার একটা শখ ছিল। ভালো লাগার গানগুলো লিখে রাখা। তাড়াতাড়ি করে ডায়রি বের করে জানতে চাইলাম, গানের একটি লাইন আছে

সেই চলে যাওয়া পাখিটার ছায়া

সেই ছায়া ধীরে মেলায় হৃদয় মেঘের ফাঁকে…”

এখানে বিষাদের ছোঁয়া। কেন?

খালিদ ভাই বললেন “সব ভালোবাসার কী মিলন হয়? মিলন না হয়েও প্রেম শাশ্বত সুন্দর রয়ে যায়। ধরে নাও এটা এমনই।”

অসাধারণ। খালিদ ভাই একজন শক্তিমান কবি এবং খুবই উঁচুমানের গীতিকবিএই গানটির কথাগুলো পড়লেই অনুধাবন করা যায়। এই গানের কোথাও ‘আমি’– ‘তুমি’ বা ‘আমরা’ শব্দ নেই। কিন্তু ভালোবাসার দর্শন আছে। বর্ণিল প্রকাশ আছে। এরপরে জানতে চাইলাম, কখন লিখেছেন এই গানটি?

খালিদ ভাই বললেন: একদিন বাসা থেকে বেরিয়ে (চন্দনপুরাস্থ নিজের বাসা) ইকবাল হোটেলে যাচ্ছি। পথে নকীব খানের সাথে দেখা। নকীব বললো গান লিখতে। আমার কবিতা সে পড়েছে। সুন্দর গান হবে। আমি আসলে তখনও ভাবিনি যে, গান লিখবো। যাক, দুইজনে ইকবাল হোটেলের সন্দেশ খেতে খেতে আমাদের অনেক আলাপ হলো। কিছুদিন পর এই কবিতা বা গান লিখে নকীবকে দিলাম। তারও কিছু দিন পর নকীব বললো সুর করে ফেলেছি। আসেন একদিন বাসায়, আপনাকে শোনাব। তখন নকীব খানের বাসা ছিল কাজেম আলী স্কুলের সাথেই। সেখানে আবার সোলস সংগীত চর্চা করতো। যাক, আমাকে শোনালো। খুব ভালো লাগলো। আমার কবিতা গান হবে এটা কখনো ভাবিনি। নকীব খুব সুন্দর সুর করেছে। পরে সোলসএর মূল গায়ক তপন চৌধুরী গানটি গাইলো। সোলসএর ক্যাসেটেও গানটি স্থান পায়। ব্যস, এই তো।

খালিদ আহসান এভাবেই বলছিলেন এই বিখ্যাত গানটির কথা। সময়কাল ১৯৮১ সাল।

এবার আসি এই গানের সুরকার নকীব খানের সুর করা প্রসঙ্গে। করোনাকালীন সময়ে আমি নকীব ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আলাপে উঠে আসে এই গানটির কথা। তাঁরও প্রিয় গান। খালিদ ভাই করোনাকালীন সময়ে ২০২১ সালে চলে গেলেন পরপারে। তখন এতটাই মুষড়ে পড়ি, খালিদ ভাইয়ের স্মৃতি আগলে রাখার চেষ্টা করি। খালিদ ভাইকে স্মরণ করে একটি অনলাইন অনুষ্ঠান করি। সেই অনুষ্ঠানে নকীব ভাই উনার অনুভূতির কথা বলেন। নকীব ভাই বলেন ‘যখন খালিদ ভাই আমাকে কবিতাটি দিলেন, যতবারই পড়ছিলাম, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এত সুন্দর কথা। এত গভীরতা। যাহোক, অল্প সময়ে গানটির সুর করে ফেলি। কিছুদিন পর গানটি খালিদ ভাইকে শোনালাম। তাঁর ভালো লাগার প্রকাশ দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হলাম। পরে খালিদ ভাইয়ের লেখা “নদী এসে পথ সাগরে মিশে যেতে চায়”এই গানটি সোলসএর জন্য রেখে দিলাম। তখন আমি সোলসএ। তপন চৌধুরী গানটি গাইলো। অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড অডিও এলবাম “সুপার সোলস”এ গানটি রিলিজ হয়। তখন চারপাশে অনেককেই গাইতে শুনি।

এভাবেই ‘নদী এসে পথ সাগরে মিশে যেতে চায়’ গানটির লেখা ও সুর করার নেপথ্যের কথাগুলো জানতে পারি। সোলসএর সুবর্ণ জয়ন্তী বছর ২০২৩। ১৯৮১ সালে খালিদ আহসানের লেখা ও নকীব খানের সুরে এই গানটির আবেদন ও জনপ্রিয়তা আজও অটুট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধপশ্চিম সিকিম