গানকে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু, নিজে গাইতেনও

রাশেদ রউফ | রবিবার , ৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভের পরপরই বাংলার কবি সাহিত্যকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগ করার জন্য বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তৎকালীন সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী পূর্বাণীর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তুলতে সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছিশিল্পী, কবি এবং সাহিত্যকদের সৃষ্টিশীল বিকাশের যেকোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে একজন সংস্কৃতি চেতনাসমৃদ্ধ রাজনীতিবিদ ছিলেন। শিল্প সাহিত্যসংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিলো একটি নিজস্ব ধ্যানধারণা, যা ছিলো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ব্যক্তিচেতনায় উজ্জ্বল। তিনি গান পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন কণ্ঠশিল্পীদের। আনিসুল হকের এক লেখায় পাই, ‘বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে যেমন, তেমনি ৩২ নম্বরের বাড়িতেও গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল। গান বাজত। তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা গান শুনতেন। বেগম মুজিব তাঁর ছেলেমেয়েদের ছায়ানটে দিয়েছিলেন। সবাই কমবেশি গান শিখেছেন, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছেন। শেখ রেহানা নাচও শিখেছিলেন। শেখ কামাল মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন, টেলিভিশনেও অভিনয় করেছেন।’

রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন আব্বাসউদ্দীনের ভাটিয়ালি গান। তার বর্ণনা পাই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। বঙ্গবন্ধু লিখেন, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেতো। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলো যেন তাঁর গান শুনছে।’ আব্বাসউদ্দীন নৌকায় ফিরতে ফিরতে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাসো, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আব্বাসউদ্দীনের কথাগুলো বঙ্গবন্ধু হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, ফলে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তিনি সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর সংস্কৃতির জগৎ। তবে বঙ্গবন্ধু নিজে গান গাইতেন, পারিবারিক আসরে গান গেয়ে শুনিয়েছেন, এই তথ্যটা আমরা পাই ‘বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী’ শীর্ষক বইয়ে। গ্রন্থের লেখক কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন : ‘মে মাসের শেষের দিকে, তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই, একদিন শেখ মুজিবের স্ত্রী টেলিফোন করে বলল, ‘ভাইসাহেব, আমাদের বাসায় দশটার সময় আপনাকে আমাদের সঙ্গে নাশতা খেতে হবে।’ আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ডাক্তারের অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে আমার খাবারের ব্যাপারে। আমি অন্য এক সময়ে তোমাদের বাড়িতে আসব।’ কিন্তু বউমা নাছোড়বান্দা। তাই আমাকে যেতে হলো। মুজিব দুতিনটি গান গাইল। তারপর সেতার বাজালো মুজিবের বড় ছেলে কামাল। সেতারে তার হাত ভালোই মনে হলো।’

এভাবেই আমরা চিনেছি গায়ক বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর ভাবনার যে রূপবৈচিত্র্য আমরা প্রত্যক্ষ করি, তার পুরোটাই ছিল অকৃত্রিম বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁকে মহীরূহ করে তুলেছে।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম থেকে যোগ দিচ্ছেন দেড়শ নেতাকর্মী
পরবর্তী নিবন্ধসিডিএকে দায়ী করলেন মেয়র