গহীন পাহাড়ে আরসার আস্তানা, টর্চার সেল

টেকনাফে সামরিক কমান্ডারসহ গ্রেপ্তার ৬, অস্ত্র উদ্ধার কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদের যত অপরাধ

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ২৩ জুলাই, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারে টেকনাফের গহীন পাহাড়ে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’র গোপন আস্তানা খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব বলছে, সেই আস্তানায় তারা একটি ‘টর্চার সেল’ দেখেছে। অপহরণ করে সেখানে মানুষকে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয় মুক্তিপণ আদায় করতে। সেই আস্তানা থেকে আরসার সামরিক কমান্ডারসহ ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে র‌্যাব১৫ বলছে, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সাতটি দেশিবিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও নগদ টাকা। যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা হত্যার পর মরদেহ গুমের সঙ্গে জড়িত বলেও জানানো হয়েছে।

শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার গহীন পাহাড়ে এ অভিযান চালানো হয় বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে করে জানিয়েছে র‌্যাব১৫।

কক্সবাজারে ইউনিট কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, টেকনাফের গহীন পাহাড়টিতে আরসা সন্ত্রাসীরা গোপন আস্তানা তৈরি করে ‘টর্চার সেল’ গড়ে তুলেছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওখানে অভিযান চালানো হয়। তিনি বলেন, গোপন আস্তানার তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথমে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও গুলি। খবর বিডিনিউজের।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলেও জানান র‌্যাব পরিচালক। তিনি জানান, হাফেজ নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে আরসার ৩০ থেকে ৩৫ জন সদস্য কুতুপালং ক্যাম্প ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তারা দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করত বলে জানতে পারার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, হাফেজ নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের নিকট হতে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদার অর্থ না পেলে অপহরণপূর্বক শারীরিক পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করতেন। মুক্তিপণ না পেলে তারা খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতেন।

র‌্যাব জানায়, তারা যে আস্তানাটি খুঁজে পেয়েছে, সেখানকার চর্টার সেলের তত্ত্বাবধান করতেন ফারুক হারেস। তারও সাত থেকে আটজনের একটি দল রয়েছে, যারা ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নেতাদের কাছে তথ্য পাঠাত। মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম ও ইয়াছিন পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন। গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জনকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করার কথা জানিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, তাদের তথ্যমতে ক্যাম্পে আরসার সাড়ে চারশ সদস্য সক্রিয়। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে র‌্যাব।

হাফেজ নুর মোহাম্মদের যত অপরাধ : টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন দিল মোহাম্মদের ছেলে হাফেজ নুর মোহাম্মদ (২৯), ধলা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), ওবায়দুর রহমানের ছেলে মো. ফারুক প্রকাশ হারেস (২৩), জমলুকের ছেলে মনির আহাম্মদ (৩৬), অলি আহাম্মদের ছেলে নূর ইসলাম (২৯) ও হোসেনের ছেলে মো. ইয়াছিন (২১)। এ সময় উদ্ধার করা হয় ১টি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ১টি শর্টগান, ৪টি দেশীয় এলজি, ৩টি দেশীয় রামদা ও গোলাবরুদসহ নগদ ৭০ হাজার টাকা।

র‌্যাব১৫ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হাফেজ নুর মোহাম্মদ মিয়ানমারের নাগরিক। ২০১৬ সালে তিনি আরসার সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে আরসায় যোগ দেন। পরে সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পান। আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তিনি কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্টপ্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। তিনি আরসার সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিতেন। আরসার সামরিক শাখার প্রধান খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও আরসার মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন হাসেম প্রকাশ কুইল্লার কাছ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন।

২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প৮ এ অবস্থান করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি ক্যাম্প৮ এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি হেড মাঝি শফি উল্লাহ, সালাম, সলিম, মালেক, হাবুইয়া, ইমান, আবুল মনসুর ও সালেহ হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক একজন মহিলার ঘরে প্রবেশের সময় বাধা দিলে ওই মহিলাকে গুলি করে হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

তিনি আরসার জন্য চাঁদা সংগ্রহ এবং আরসার শীর্ষ নেতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করতেন। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ/টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকায় আত্মগোপনে থাকতেন। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫ বেশি মামলা রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঝালকাঠিতে বাস উল্টে পুকুরে, নিহত ১৭
পরবর্তী নিবন্ধগণ্ডামারায় তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু