বিকেল ৪ টায় চেরাগি এসে বসে আছি। অন্যদিনের চেয়ে আজ অস্থিরতা বেশি। অপেক্ষা করছি কখন ৫টা বাজবে আর রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে। এ-নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা হবে, প্রথম দেখেছিলাম চট্টগ্রামের শিল্পকলা একেডেমিতে, তারই নির্মিত ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চারার’ নামক শর্টফিল্মের প্রদর্শনীতে। আমার হাজারো প্রশ্ন, জানার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তুমুল বৃষ্টি-উপেক্ষা করে এবারের সাক্ষাত। উপলক্ষ- তাঁর প্রথম বই ‘নৈঃশব্দের মানুষেরা’ লেখকের সইসহ নেয়া।
চট্টগ্রামের মানুষ রফিকুল আনোয়ার রাসেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ১৯৯৮ সালে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হোন। ‘অযান্ত্রিক’ নামক ফিল্ম এবং মিডিয়া স্টাডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৬ সালে। ২০০৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে ফিল্ম নির্মাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ২০১৪ সালে ‘দ্যা অ্যাডভেঞ্চারার’ নামক শর্টফিল্মের জন্যে পান আন্তর্জাতিক পরিচিতি। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয় নিয়ে ‘আ মেন্ডলিন ইন এঙাইল’ তৈরি করেন। আর, বই- এবারই প্রথম।
ঘরে প্রবেশ করতেই দেখি কাঁচাপাকা চুলের এক মানুষ। গলার স্বর অত্যন্ত ভারী। সারা ঘর জুড়ে অজস্র বই। শারীরিক জটিলতা থাকার পরও তারুণ্যের উদ্দীপনা এক রতিও কমেনি। এ-আড্ডায় যারা সঙ্গ দিয়েছিলেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। রাসেল ভাই জেনে নিলেন আমরা কে কি করি। সিনেমা জগতে রাসেল ভাইয়ের প্রথম দিকের গল্প শোনার আবদার যেনো রাসেল ভাইকে চেনার পথ সহজ করে দেয়। সিনেমা শেখার শুরু দিয়ে আমাদের আসল আড্ডারও শুরু।
“১৯৯৮ সালের দিকে আমি ঢাকায় প্রথম সিনেমার একটি কোর্স করতে গিয়ে নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল স্যারের সাথে পরিচয়। কোর্স পরিচালক হিসেবে তিনি ইন্টারভিউ নিতেন আবেদনকারীদের। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার শেষ দেখা ভালো একটি সিনেমার নাম বলো’। আমিও খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, ‘আ ওয়াক অন দ্য ক্লাউড’। তখন সিনেমার ডিরেক্টর ধরে নাম বলার অভ্যাস ছিলো না। বোকার মতো বলে বসলাম, ‘কিয়ানু রীভস অভিনীত সিনেমা, দারুণ স্যার, দেখে নেবেন প্লিজ।’ তিনি কিছু বললেন না। কর্মশালায় টিকে অবশ্য বুঝলাম আসল সিনেমা কাকে বলে!”
কথার ফাঁকে এলো চা। আলাপ জমে উঠলো রাজনীতি, দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ, বাম রাজনীতি নিয়ে। চট্টগ্রামের সিনেমা জগতে রাসেল ভাইয়ের অবদান অসীম। চট্টগ্রামের বাইরে সিনেমা নিয়ে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতাও জানালেন। ‘বাইরে গেলেই বোঝা যায় এখনো আমি চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী। প্রতিদিন সিনেমা নিয়ে শিখতে ভালো লাগে।’
রাসেল ভাইয়ের গভীর দর্শন আমাদেরও ভাবনায় ফেলে দেয়। তার দর্শনের এ-জগতের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন, রয়েছে এ-নিয়ে তার নিজস্ব চেতনাও। দেশ, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ- এসব নিয়ে আমাদের এ-প্রজন্মের নানা ভ্রান্ত ধারণাও একে একে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছিলো তার আলোচনায়। তিনি বললেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত শিক্ষিতমহল তথা বুদ্ধিজীবী, আমলা, সরকার- প্রত্যেকেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। এদেশের প্রতিটি শিক্ষিত নাগরিকের নিজ দেশের সঠিক ইতিহাস পাঠ অনেক জরুরি।’
জয়ের সাথে সংগ্রাম থাকবে। রাসেল ভাইও জানালেন তার সিনেমা জগতে একলা পাড়ি দেবার কথা এবং সংগ্রামের গল্প। জানতে চাইলাম তরুণ সিনেমা নির্মাতারা কীভাবে সিনেমা বানানো শিখবে। রাসেল ভাইয়ের সহজ উত্তর, “আগে ঠিক করতে হবে- কি করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে গল্প করতে করতে বোঝার চেষ্টা করতাম, শিক্ষার্থীরা কি করতে চায়, কি বুঝতে চায়। শিক্ষক হিসেবে আমরা তাদের ইনফেরিয়র করে দেই- তারা এটা দেখেছে কিনা, ওটা জানে কিনা জিজ্ঞেস করি। আমি সহজভাবে প্রশ্ন করতাম, ‘মজার কি ছবি দেখেছেন? কুংফু পান্ডা দেখেছেন কিনা?’ তাদের সহজ করতে আমি দেখিয়ে দেই- দেখুন কি সুন্দর একটি সিনেমা খুব সহজে শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। তুমি হেরে যাবে, অনেকবার হারবে, হয়তোবা জিতবে না কিন্তু তোমার কাজ হল- তুমি কখনো থামতে পারবে না। থামা যাবে না। থেমে গেলেই সত্যিকার পরাজয়।”
রাসেল ভাই ২০১৪ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করে আসছিলেন। জানতে চাইলাম, তিনি নিজে কোন শিক্ষক থেকে সিনেমা শিখেছেন। সাবলীলভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমি ব্যক্তিশিক্ষক হিসেবে বিশেষ কোন গুরুর কাছ থেকে সিনেমা শিখতে পারিনি। একেবারে মাঠ পর্যায়ের মানুষ, তাই হয়তো শিষ্য হবার জন্য অনুপযুক্ত ছিলাম। বলেই হা হা করে হেসে দিলেন। ‘সিনেমা শিখেছি পৃথিবীর মহৎ পরিচালকদের কাছ থেকে। আমি তাদের সিনেমা দেখেছি। শুধুই সিনেমা দেখেছি।’
দীর্ঘ আড্ডার ফাঁকে নিজেই বের করে তার সদ্য প্রকাশিত গল্পের বই নৈঃশব্দের মানুষেরা। উল্টে-পাল্টে দেখতেই চোখে পড়লো বাবাকে উৎসর্গ করা। কারণটা জানতে চাইলাম, বললেন, ‘বাবা মূলত আমার মতোই গল্পবাজ মানুষ ছিলেন।’
রাসেল ভাইকে এবারের মত রেহাই দিয়ে আবেশ নিয়ে যে-যার ঘরে ফিরলাম। স্নিগ্ধ বাতাস দিচ্ছে, সাথে রিক্শায় নিয়ন আলোর খেলায় মাথায় ঘুরছে কখন বাসায় গিয়ে বইটি পড়ব। পথ যেনো রাসেল ভাইয়ের কথা দিয়ে ক্যাসেট বাজিয়ে ফিরছে। বাসায় এসে বসে পড়লাম বই হাতে। রাসেল ভাইয়ের নিজের হাতে সই করা বই যেন আমার কাছে এক প্রাপ্তি। বইয়ের প্রথম পাতা উল্টোতেই বুঝতে পারি চট্টগ্রাম রাসেল ভাইয়ের প্রাণের শহর। বাবাকে উৎসর্গ করা এ-বই যেন বাবার দেওয়া স্মৃতির এক টুকরো। রাসেল ভাই গল্পের ছলে কথা বলেন, সত্য স্পষ্ট কথার ধরণ গল্পে ফুটে উঠেছে। ন’টা গল্পে এ-বই। প্রতিটি গল্পেই মানুষকে নিয়ে নিখুঁত বিশ্লেষণ। রফিক আশিকীর মনের গভীরতার আঁচ যেমন পাওয়া যায়। বাস্তব জীবনে আমাদের টাকার পিছে ছোটার মানসিকতার কথাও বলতে ভোলেননি। রফিক আশিকী না পড়লে কর্ণফুলী নদীকে আমার চেনা হতো না, যার বুকে এত গল্প। বাবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প যেনো রাসেল ভাইয়ের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। সানাউল্লাহর জীবন আমাকে ভাবায় পাপী আর মুক্তির সমীকরণ। সবচেয়ে নান্দনিক সৃষ্টি মোনাপ। কেননা রবার্ট ফ্রস্টের সাথে এভাবে মোনাপের অনুধাবন নিখুঁত মনের পরিচায়ক। রাসেল ভাইকে গল্পের কবি বললে ভুল হবে না। নদীর সাথে বুড়ি মা আর সন্তানের আর্তনাদ আমার জানা কথা। আবার পড়ছি ভেবে একটু নড়ে বসি, কিন্তু না শেষ অব্দি পড়ে বুঝলাম সাধারণ চোখে এটি অসাধারণ কচ্ছপবুড়ির গল্প। ফটোগ্রাফ গল্পে খুঁজে পাই আমার প্রশ্নের উত্তর। বাঘ মামার কথা শুনে হাতে তালি না দিয়ে আমি কেঁদে ফেললে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ শেরুর গল্পে একই সাথে অনেক স্বাদ পাবেন। শেরু গল্প নিয়ে লেখার সাহস হয়নি তবে শেরুকে সাহস দেওয়ার মত আমারো বাঘ চাই। আর শেষের গল্প ‘শেষ সংবাদ’ যেনো অসীম এক নীলাভ পথের শুরুর গল্প।
রাসেল ভাইয়ের নিখুঁত চোখে শুধু মানবচরিত্রই নয়, ধরা দিয়েছে চট্টগ্রামের নানারূপ। মানুষ তো শহরেরই। শহরটাকে না জেনে মানুষটাকে কিংবা মানুষগুলোকে না জেনে শহরটাকেই বা কি করে চিনি!