পর্ব ১
হুমায়ূন আহমেদের রচনার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে গল্পে তাঁর নিজস্বতা ও মৌলিকত্ব। এছাড়া তাঁর গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো–গল্পগুলো সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ও জীবনঘনিষ্ঠ। যে কারণে তাঁর বেশির ভাগ রচনাই পাঠক আপন করে নিয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ গল্প লেখার কৌশল জানতেন। তিনি এ–ও জানতেন যে পাঠককে কোথায় থামিয়ে দিতে হয় এবং উৎকণ্ঠায় রেখে কত বিচিত্রভাবে তাদের কৌতূহল বাড়ানো যায়। নতুন আখ্যান তৈরি করে তার মাধ্যমে তিনি বাঙালির চিরদিনের কান্না–হাসিকে পাশাপাশি উপস্থাপন করেছেন। লেখক কাহিনি সংঘটনের চেয়ে গল্পের জমাট বাঁধানোর দিকেই এগিয়েছেন বেশি। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর আখ্যান হয়েছে নির্মেদ ও ডালপালাহীন। গল্পের ব্যাখ্যা নয়, তিনি কেবল ঘটনার নির্মোহ বর্ণনা দিয়েছেন। কারণ, ব্যাখ্যা করার এই দায়িত্ব বরং তিনি সর্বদাই দিয়ে রাখেন পাঠকের ওপর। এটাকেই বলে ঘটনার সঙ্গে পাঠকের অন্তর্ভুক্তি। ঘটনা বিশ্লেষণে তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন পাত্র–পাত্রীর দৃষ্টিকোণ। তিনি দৃশ্যমান বর্ণনায় যেমন ইঙ্গিতময় ছবি আঁকতে পারেন, আবার ইঙ্গিতময় বর্ণনার মধ্যে একইভাবে দৃশ্যমান ছবি জুড়ে দেন। হুমায়ূন আহমেদের আখ্যানের গল্পটি শেষ করে পাঠক সুখনিদ্রা যেতে পারেন না। তাঁদের অনেকক্ষণ ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় থাকতে হয়। আখ্যানের গল্পটিতে হুমায়ূন আহমেদ একই সঙ্গে মায়া ও সম্মোহন তৈরি করেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যের আখ্যানে গল্পকে হঠাৎ থামিয়ে দেওয়ার নতুন কৌশল সৃষ্টি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। নাটকীয়তা ও অতিনাটকীয়তার এমন বিচিত্র ব্যবহার হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে এত বিচিত্রভাবে কেউ করেননি। প্রতিটি উপন্যাসের কাহিনি তিনি শেষ করেছেন মুক্ত উপসংহার রীতিতে।
বাংলা কথাসাহিত্যের আখ্যানে গল্পকে হঠাৎ থামিয়ে দেওয়ার নতুন কৌশল সৃষ্টি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ।
গল্পের মাঝে প্রাণ সৃষ্টি করায় অপূর্ব দক্ষতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। মধ্যবিত্তের জীবনের অজস্র সাধারণ গল্পের এক একটিকেই গাঢ় মমতা মিশিয়ে তিনি বলতেন তাঁর উপন্যাসগুলোতে। খরস্রোতা নদীর মতো তরতরিয়ে বয়ে চলা সেই গল্পগুলোর মধ্যে একই সাথে থাকে হাস্যরস, যাপিত জীবনের টুকরো টুকরো অজস্র আনন্দ বেদনার গল্প। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এতটাই কাছের যে, পাঠকরা নিজেকেই যেন খুঁজে পায় গল্পের পাতায় পাতায়।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার এমনই জাদু যে জোর করে মনোযোগ ধরে রেখে তার বই শেষ করার প্রয়োজন হয় না, বরং এর গল্পই পাঠককে আপন গতিতে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে চলে। পাঠক হৃদয় জয় করতে পারার এই অসামান্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই জীবনকালে পেয়েছিলেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা, আবার মৃত্যুর পরেও সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে তিনি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।
বলাবাহুল্য, মেঝেতে ল্যাটা মেরে বসে সামনে টুলের ওপর কাগজ রেখে হাতের লেখায় তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখালেখির জগৎ নির্মাণ করেছেন।
মোটা দাগে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী সংকট, গ্রামের কৃষিজীবন, বহু আগের জমিদারবাড়ি, সামন্ত প্রথা, মধ্যবিত্তের ঘরকান্না, চায়ের দোকানের আড্ডা, হাওয়া মে উড়তা যায়ে–হিন্দি গান–সব মিলিয়ে গত শতকের সত্তর দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের বিস্তৃত বাংলাদেশই ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখার জগৎ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। বাংলা সাহিত্যে গল্প লেখার ক্ষেত্রে আজ অবধি কেউ হুমায়ূন আহমেদকে অতিক্রম করতে পারেনি। অসাধারণ সব গল্পের ঝাঁপি উপহার দিয়েছেন পাঠক মহলকে।
‘অদ্ভুত সব গল্প’ বইটি প্রকাশ করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পাঁচটি অদ্ভুত গল্পের সংকলন হিসেবে। পাঠকরা দারুণভাবে লুফে নিয়েছিল ‘অদ্ভুত সব গল্প’ নামক বইটিকে।
প্রথম গল্প : গুণীন
চান্দ শাহ ফকিরের আসল নাম সেকান্দার আলি, তার স্ত্রীর নাম ফুলবানু। ফুলবানু পাঁচ বছর যাবৎ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। চান্দ শাহের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো আয় রোজগার নেই বললেই চলে। তিনি খুব গল্প করতে ভালোবাসেন। নানান ধরনের ফকিরি গল্প তিনি করেন, সকলকে বলেন তিনি নানান তন্ত্রমন্ত্র জানেন। আসলে সবই বোগাস। তিনি যখনই শোয়ার সময় গল্প শুরু করেন তখনই তার স্ত্রী ভীষণ রেগে যায়। একদিন রাতে তার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলে, তারপরেও তার স্ত্রী তাকে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে বসতে বলল। তিনি বাইরে বসে রইলেন। এমন সময় হঠাৎ একটা পরী এসে তার সাথে দেখা দিলো। পরী তাকে অনেক কিছুই দিতে পারে, কিন্তু যে কোনো একটা তাকে চাইতে হবে। সেকান্দার আলি চাইল ফুলবানু যেন সুস্থ হয়ে যায়। পরী ফুলবানুকে সুস্থ করে দিয়ে চলে গেলো। কিন্তু হায় এই সত্যি কথাটা তার স্ত্রী কোনোদিন বিশ্বাস করে নাই।
দ্বিতীয় গল্প : আয়না
শওকত সাহেব ছোট একটা আয়নাতে শেভ করেন। আয়নাটির স্ট্যান্ড ভেঙে গেছে বলে কিছু একটাতে ঠেকা না দিয়ে, তাকে দাঁড়া করানো যায় না।
শেভ করতে গিয়ে তিনি গাল কেটে ফেললেন, সেই সময় তিনি দেখতে পেলেন আয়নার ভেতরে একটি ছোট্ট মেয়ে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি বলে উঠলো -‘আপনার গাল কেটে রক্ত বের হচ্ছে।’
শওকত সাহেবের অফিসে নতুন কম্পিউটার এসেছে, এখন থেকে সব হিসাব কম্পিউটারে করা হবে। তিনি কম্পিউটার মোটেও পছন্দ করেন না। যে ছেলেটি কম্পিউটার শেখাচ্ছে সে সবাইকে শিখিয়ে ফেলেছে শুধু তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই শিখতে পারেননি। এক সময় তিনি হাল ছেড়ে দেন, তার দ্বারা কম্পিউটার শেখা হবে না। কিন্তু ছেলেটি হাল ছাড়ে না, তাকে শেখাতে চেষ্টা করে যেতেই থাকে। এবং এক সময় তিনি কম্পিউটার চালানো শিখে যান।
আয়নায় যে মেয়েটি আছে তার নাম চিত্রলেখা। আয়নার মেয়েটির সাথে তার কথা হয় কিন্তু তিনি মনে করেন তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন, আয়না আসলে কেউ নেই। মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে মেয়েটার প্রতি তার খুব মায়া জন্মে যায়। একদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে তিনি দেখেন পুরানো আয়নাটি নেই। তার স্ত্রী পুরানো আয়নাটি ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটা কিনে এনেছেন। পুরানোটা যে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে, সেই ডাস্টবিনে গিয়ে ময়লার মাঝে শওকত সাহেব আয়নাটি খুঁজতে থাকেন। তার সারা গা ময়লায় মাখামাখি হয়ে যায়।
তৃতীয় গল্প : কুদ্দুসের এক দিন
কুদ্দুসের মেট্রিক পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে তার বাবাকে সাপে কাটে। বাবা মারা যাওয়ার কারণে তার আর পড়ালেখা করা হয় না।
এখন সে মাঝবয়সী লোক। নানান ধরনের ছোটোখাটো কাজ করা সে জীবন অতিবাহিত করেছে। বর্তমানে একটা পত্রিকা অফিসে ফাই–ফরমাস খাটার চাকুরি করে। একদিন অফিসের বড় সাহেব একটা চিঠি হাতে হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাকে পাঠায়। যেখানে পৌঁছাতে হবে সেটা দশতলা একটা দালান। কুদ্দুস লিফটে উঠার পরেই সমস্যা শুরু হয়। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আধো অন্ধকার হয়ে লিফট বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বিদ্যুৎ ছাড়াই লিফটটি সাইসাই করে চলতে শুরু করে। লিফটটি যখন থামে কুদ্দুস তখন লাফ দিয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে আসে। বিচিত্র কোনো কারণ লিফটটি কুদ্দুসকে ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে বের করে নিয়ে চতুর্মাত্রিক জগতে নামিয়ে দেয়। চতুর্মাত্রিক প্রাণীদের সাথে কুদ্দুস বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে। তারা কুদ্দুসকে বেশ পছন্দ করে। প্রাণীদের কাছে সময় স্থির, তাই তারা ঠিক করে কুদ্দুসকে তারা তার বাবাকে সাপে কাটার আগ মুহূর্তে ফেরত পাঠাবে। সে তার বাবাকে সাপে কাটার হাত থেকে বাঁচাবে, পরীক্ষা দিবে। নতুন আরেকটা জীবন পাবে।
চতুর্থ গল্প : ভাইরাস
নুরুজ্জামান সাহেব একটি রেস্টুরেন্টে খেতে বসে আরেক ভদ্র লোকের সাথে আলাপ হয়। সেই লোক নিজেকে ভাম্পায়ার বলে দাবি করে। তার বক্তব্য হচ্ছে ভাম্পায়ার একটা ভাইরাসজনিত রোগ। রক্তবাহী এই ভাইরাস মৃত্যুহীন। যে মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় সেই মানুষ মারা গেলে ভাইরাসগুলিও মারা যাবে বলে ভাইরাসরা কোনোভাবে সেই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ভাম্পায়ারদের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা রোদের দিকে তাকাতে পারে না, তাই তারা সানগ্লাস পরে থাকে, আরা তাদের কোনো ছায়া পরে না। নুরুজ্জামান সাহেবেরও কোনো ছায়া পরে না।
পঞ্চম গল্প : নিজাম সাহেবের ভূত
নিজাম সাহেব রাতে বাসায় ফেরার সময় ট্রাকের নিচে চাপা পড়েন। ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার পরেও তিনি কোনো ব্যথা পেলেন না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি বুঝতে পারলেন যে আসলে তিনি মারা গেছেন। তিনি সবাইকে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। এমন সময় একজন তাকে ডাকলো, সেও একজন ভূত। দুজনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। এক সময় নিজাম সাহেবের ভূত পিঠে এক ধরনের টান অনুভব করলেন। তিনি দেখলেন তার পিঠ থেকে একটা ফিতা বেরিয়ে গেছে মৃতদেহের দিকে। অর্থাৎ নিজাম সাহেব এখনো মারা যাননি, ডাক্তাররা চেষ্টার করছে তাকে বাঁচাতে।