জীবনের খণ্ডাংশ ফুটে উঠে গল্পে। তাই পাঠক আনন্দ পায় গল্প পড়ে। বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ শাখা ছোটগল্প। যা পূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। এ সময়ের গল্পকাররাও লিখছেন দুই হাত খোলে। এর কোনো কোনোটি নাড়া দেয় চিত্তে। তাই এখনো পাঠক খুঁজে বেড়ায় গল্প। বইমেলার স্টলে স্টলে উপস্থিত হয়ে জানতে চান, নতুন গল্পের বই এসেছে?
বইমেলা ঘিরেই গ্রন্থ প্রকাশ। উন্নত বিশ্বে এমন চল না থাকলেও বাংলাদেশে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এর সতত্য মিলেছে এবারের বইমেলায়ও। প্রচুর বই বেরিয়েছে এবার। এর মধ্যে আছে গল্পগ্রন্থও। এর মধ্যে চট্টগ্রামের গল্পকারদের গল্পগ্রন্থগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। অবশ্য উপন্যাস, কবিতা, শিশুতোষ গ্রন্থের চেয়ে চট্টগ্রামের লেখকদের গল্পগ্রন্থ তুলনামূলক কম।
এবার প্রকাশিত চট্টগ্রামের গল্পকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’ ও ‘শাহজাদীর শয্যা’, ওমর কায়সারের ‘প্রেম ও সম্পর্ক’, মানজুর মোহাম্মদের ‘পঞ্চশ পাখির গল্প’, নির্ঝর নৈঃশব্দের ‘অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা’, ফরিদা ইয়াসমিন সুমীর ‘কালো কালো আলো’, কাজী জাহাঙ্গীরের ‘আমিও কি তবে ভালোবাসি তারে’, রুনা তাসমিনার ‘সুবাসিত নক্ষত্ররাত’, সুভাষ সর্ব্ববিদ্যার ‘উপসংহার অন্য বিকেল’, শোয়ায়েব মুহামদের ‘ফাদার ম্যানরিক’, জাকির তালুকদারের ‘কল্পনা চাকমা ও রাজার সেপাই’। এবার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই সাড়া ফেলেছে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলমান বইমেলায়। এর মধ্যে রাশেদ রউফের ‘সমকালীন চট্টগ্রাম সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রসঙ্গ’ এবং জাহেদ মোতালেবের ‘চালতা পোড়া গদ্য’ অন্যতম।
রাশেদ রউফ তাঁর প্রবন্ধগুলোতে চট্টগ্রামের প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা, চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্য এবং চট্টগ্রামের বইমেলার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন চমৎকার গদ্যে। দুটো অধ্যায়ে ২৩টি প্রবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রামে বইমেলা : গুরুত্ব ও তাৎপর্য, চট্টগ্রামের প্রকাশনা শিল্প ও সংকট ও সম্ভাবনা, চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্য, চট্টগ্রাম বেতার : ভালোলাগার, ভালোবাসার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্র : চট্টগ্রামের মানুষের জন্য বড়ো সম্পদ, বড়ো প্রাপ্তি, দৈনিক আজাদীর ৬০ বছর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণিত; পেছনে তাকালে বুক হুহু করে ওঠে, পহেলা বৈশাখ : যে উৎসবে আমরা প্রাণিত হই, চেতনার আলো আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও তাঁর ছড়া, বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক, জনতার নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী : যিনি ছিলেন চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, ময়ুখ চৌধুরী : সুন্দরের সন্ধানে নিপুণ অভিযাত্রী, সিদ্দিক আহমেদ : হাজারো অপ্রাপ্তির ভেতরেও মাথা উঁচু ছিল যার, বেগম মুশতারী শফী : অদম্য সংগ্রামী মানুষের পথিকৃৎ এবং সাহিত্যব্যক্তিত্ব অরুণ দাশগুপ্ত : লেখকের মানস-গঠনে যার অবদান অসামান্য।
ভিন্ন এক জাহেদ মোতালেবকে পাওয়া যাবে মিঠে-কড়া ভাষা, দুপুরের রোদ আর শেষ বিকেলের আলোয় মেশানো ‘চালতা পোড়া গদ্যে’। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘লেখা লেখকের ভেতরে কীভাবে তৈরি হয়? চশমার ফাঁক দিয়ে ইলিয়াস কেমন করে দেখেন? অনিলের লোহার সেই লাঠির ঝনঝনানি আর গয়ালের চোখ তুলে আনেন ভিন্ন বয়ানে। কখনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যায় মহাকালের রেখা।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’ গ্রন্থে ১৬টি গল্পে তরুণ-তরুণীর জীবনের আনন্দ-বেদনার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। ‘বর্ণনার ছটা নেই, ঘটনার ঘনঘটাও নেই, কিন্তু নির্ভার গদ্যে এ রচনায় উঠে এসেছে এমন কিছু বিষয়, যাতে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মন। আবার কখনো তাতে বিষাদের গাঢ় রং, পাঠ শেষ করেও যার রেশ ফুরোয় না। এ অনেকটা বসন্তের এক ঝলক তাজা হাওয়ার মতো জানালার পর্দা কাঁপিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ে, আর কী এক অজানা অনুভূতিতে ভরিয়ে তোলে ঘর। একটি বেদনামধুর গানের কলির মতো সঞ্চারিত হয় হৃদয়ে। সারা দিন ধরে তার গুঞ্জরণ চলতে থাকে, চলতেই থাকে। প্রতিদিনের শত ব্যস্ততার জীবনেও এই অনুভবের অনুরণন থেকে মুক্তি নেই-কারণ বিষয়টির নাম প্রেম।’
ওমর কায়সারের ‘প্রেম ও সম্পর্ক’ গ্রন্থে গত কয়েক দশকের বিভিন্ন সময়-পর্বে বিভিন্ন বয়সের নর-নারীর সম্পর্কের বিচিত্র ভাব-অনুভাব-জটিলতা উঠে এসেছে। প্রেম কি সম্পর্ক? সম্পর্ক কি প্রেম? পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে প্রেম নিঃসন্দেহে বিশেষ। মূলত সেই বিশেষ সম্পর্কের কিছু গল্প স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, সম্পর্কের ধরন-প্রকৃতি সব কালে এক না। মানুষ সম্পর্ক নিয়ে বাঁচে। ভালো থাকে। আবার সম্পর্ক নিয়ে একশেষ হয়ে যায় কেউ কেউ। প্রেম ও সম্পর্ককে ঘিরে এই গল্প আমাদেরকে জীবনের দিকে ফেরায়। নিজেকে আবিষ্কারের উপলব্ধি আনে।
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যার ‘উপসংহার অন্য বিকেল’ এর গল্পগুলো ছুঁয়ে যাবে মন। গল্পগুলোতে উঠে এসেছে ‘মানুষের চলমান জীবন, জটিল মনোবৈকল্য, পয়মস্ত ভালোবাসা কিংবা বিষাদময়তা, জীবনের টানাপোড়েন, সমকালের নিরন্তর ভাঙচুর, যাপিত জীবন, জন-মানসের অনন্তযাত্রা’।
শোয়ায়েব মুহামদের ‘ফাদার ম্যানরিক’ পাঠককে নিয়ে যাবে অন্য কোথাও? ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘সেকালের ফাদার ম্যানরিক একালে এসে হাজির হয়। হাটের খেলায় যে ছেলেটিকে কেটে দুই ভাগ করা হয়েছে সে কি জোড়া লাগবে? বিভ্রমে পড়া নারী, শরিফা অথবা মেজ চাচির স্মৃতি, অলৌকিক কিছু মানুষ আর বাস্তবের একেবারে গভীরে থাকা ধূর্ত ব্রোকার; এসব মিলেই শোয়ায়েব মুহামদের গল্পগ্রন্থের জগৎ।’
‘এই যে দেশ, একবার তাকে হারালে নতুন দেশ পাওয়া কঠিন। চোখের মণির মতো দেশকেও ভালোবাসিস, আগলে রাখিস। কিন্তু কে কাকে আগলাবে?’ এমন প্রশ্নের উত্তর মিলবে জাকির তালুকদারের ‘কল্পনা চাকমা ও রাজার সেপাই’-এ। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘রাজার দেওয়া ছন্নছাড়া দুর্দশা, বনদেবীর সন্তান ওরাওঁ, সাঁওতাল বা কল্পনা চাকমা; মানুষের বিপন্নতা আর বেঁচে থাকার এক টুকরো স্বপ্ন গভীর দরদে তুলে আনেন জাকির তালুকদার। গল্প পড়তে পড়তে তীব্র শীতে মন কুঁকড়ে যায়’।
গতকাল ছিল বইমেলার সপ্তম দিন। মেলার আয়োজক সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। মেলা চলবে ১০ মার্চ পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে।
মোড়ক উন্মোচন : মোহাম্মদ আবদুল মজিদ অনূদিত ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর আইন’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম, সচিব খালেদ মাহমুদ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, অনুবাদক মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। বক্তারা বলেন, বইটিতে সিটি কর্পোরেশনের গৃহকর ও ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত আইন-কানুনসমূহের মৌলিক বিষয়গুলোকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।