পর্ব ২
সিলেটের বাইরে যে–সমস্ত জায়গায় আমার যাতায়াত তার মধ্যে অন্যতম আমার মামা ও মাসীদের বাড়ি। আমার দুই মামা। দুইজনই চাকুরিজীবি ছিলেন। ছোটো মামা ডানকানের চা–বাগানে চাকুরি করতেন। ফলে টিলা–ছড়া–ঝিরি অধ্যুষিত বাগান এলাকায় তার স্টাফ কোয়ার্টারে বাৎসরিক ছুটিযাপন করার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। তাঁর চান্দপুর বাগানের কোয়ার্টারে আমি এসএসসি পরীক্ষার পর মাসদুয়েক ছিলাম। সমরেশের কালবেলা–কালপুরুষ–উত্তরাধিকার–গর্ভধারিণীর আরণ্যিক বিবরণ যেন আমি নিজমনে চেখে দেখেছি ওখানে। আর বড়ো মামা ভোকেশনাল কলেজের শিক্ষকতা করতেন। মৌলভীবাজার ভোকেশনালে দীর্ঘদিন ছিলেন। ওখানেই সুপারিন্টেন্ড হিসেবে অবসর নেন। তাঁর কোয়ার্টারও ছিলো টিলা–অধ্যুষিত এলাকায়। আমাদের ভাইবোনদের চড়ুইভাতি, পুতুলের বিয়ে, লুকোচুরি, বন্দী, কানামাছি খেলার বন্দোবস্ত যেন প্রকৃতি নিজহাতে সাজিয়েছিল। ছোটো মাসীর বাসা শ্রীমঙ্গলে। ফলে বাৎসরিক ছুটিতে দুই মামা ও ছোটো মাসীর বাড়ি পরিভ্রমণেও অধিক আগ্রহের কেন্দ্র্রবিন্দু ছিল টিলা। বড়োবেলায় এসেও দেখি পাহাড়–টিলা খুবই টানে। কিন্তু এই টানকে চরিতার্থ করার মতো বাস্তবতা দিনদিন কমে আসছে। কত সকাল যে বিকেল হয়েছে, রাত যে দিন হয়েছে টিলা আর অরণ্যের ইশারায় তার হিসেব আর মনে নেই। এ টানটা কেমন? –বলাটা কঠিন!
গত নভেম্বরে (২০২৪ খ্রি.) যখন জীবনের প্রথম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠছিলাম, ছোড়দির কথা মনে পড়ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। ছোড়দির দেয়া তীর্থযাত্রীদের কষ্টের বিবরণ যেন গল্পের বর্ণনা থেকে উঠে এসে আমাকে একদম বাস্তবে ঝেঁকে ধরেছিল। পরিশ্রমহীন শরীরের অপরাগতাকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যাওয়ার এই যাত্রাটা যদিও কোনওভাবেই একজন তীর্থযাত্রীর ছিল না, কিন্তু মনের দুর্নিবার এক শক্তি আমাকে টেনে তুলছিল। আমার ভ্রমণসঙ্গী শিল্পী পংকজ চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় হেসেখেলে উঠছিল, আর যেহেতু ওখানে তাদের নিত্য যাতায়াত ফলে তাদের উপর ভরসা রেখে ও পরামর্শ মেনেই এগুচ্ছিলাম। উচ্চতার বিচারে কোনও পর্বতারোহীর কাছে এ পাহাড় হয়ত গোনায় পড়বে না, কিন্তু আমার মতো মানুষের জন্য এ পাহাড়ভ্রমণ যেমন কষ্টসাধ্য, তেমন আরোগ্যদায়ীও। হলোও তাই। বিরুপাক্ষ মন্দিরে যখন পৌঁছতে পারলাম খুব দ্রুতই ক্লান্তি শুষে নিলো তার নৈসর্গিক রূপ। পাহাড়ের গায়ে লেগে যাওয়া ভাসমান মেঘেদের মতোই সুখী হয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পড়েই এক পশলা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির বিরতিতে হাজার বছরের পুরনো মন্দিরের গায়ে ঝলকে উঠল সোনালি রোদ। সোনালি রোদের আভায় আচমকা চোখ পড়লো মাটির দিকে। চারদিকে ছড়ানো খাদ্যদ্রব্য, আগরবাতি আর কোমল পানীয়ের প্লাস্টিকজাত প্যাকেট ও বোতল। ট্যুরিস্ট নামক প্রাণীদের যথেচ্ছাচারের সাক্ষ্য। কেউই দায়িত্বশীল নয়? সাধু? তীর্থক্ষেত্র–কমিটি? অথবা রাষ্ট্র? উল্টো দেখলাম দুই মন্দিরের মাঝখানে খাদ্য–পানীয়ের দোকান। যেটি প্লাস্টিকবর্জ্যের অন্যতম উৎস। বিষয়টি মনে করিয়ে দিলো পিটাছড়া আর্টক্যাম্পের কথা, আমার রাসেল ভাইয়ের কথা।
সেবার মাটিরাঙায় প্রাণ–প্রকৃতি রক্ষার স্লোগানকে সামনে রেখে তিনদিনের আর্ট ক্যাম্পে সারা দেশ থেকে শিল্পী ও লেখকরা যুক্ত হয়েছিলেন। আমিও যুক্ত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো। বন্ধু চিত্রশিল্পী ও কবি জন মহম্মদের জন্যই মূলত পিটাছড়ায় প্রথম যেতে পেরেছিলাম। প্রায় এক বছর ধরে যাব যাব বলে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। ক্যাম্পে সবাই আলাপ–আলোচনা–গান–আড্ডায়–আঁকায় বুঁদ। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম রাসেল ভাই হাতে করে দু’মুষ্টি পরিমাণ সিগারেটের উচ্ছ্িবষ্টাংশ নিয়ে উপস্থিত। আর্টক্যাম্পের অংশীজনদের কাজ। একটা উচ্ছ্িবষ্টাংশের জন্য কতগুলো ক্ষুদ্র প্রাণীর জীবন ব্যাহত হতে পারে তা ভাবনায় নিয়ে আসেন রাসেল ভাই। সচেতনভাবে তো আমরা একটা সিঙ্গেল প্রাণীর ক্ষতি করতে চাই না। কিন্তু অসচেতনভাবে করেই ফেলি। ২২ একর জায়গায় প্লাস্টিকের নামগন্ধ নেই। এটা রাসেল ভাই দ্বারাই সম্ভব। লোকটি বড়োই সন্ত–স্বভাবের। বিলেতের উচ্চ–বেতনের চাকুরি, নাগরিকত্ব, বাড়িগাড়ি, বিত্তবৈভব বাদ দিয়ে মাটিরাঙার জঙ্গলে কুটিরে জীবন স্থির করেছেন। অ্যামাজন বনে আদিবাসীদের সাথে অর্থকড়ি ও আধুনিক সুযোগসুবিধা ছাড়া মাসকয়েকের জীবনযাপন তার চিন্তাজগতে বিশাল মোড় তৈরি করে। তারপরই শুরু হয় তার অনন্য এ সবুজযাত্রা। রাসেল ভাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রায় ২২ একর জমি লিজ নিয়ে প্রাকৃতিক বনসংরক্ষণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছেন, যার নাম পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ । বিলুপ্তপ্রায় পিটাপাখির উপস্থিতি এখানে দেখা যায়, তাই এর নাম পিটাছড়া করেন। মাটিরাঙার পূর্ব খেদাছড়ার অর্জুনটিলায় এর অবস্থান। পাকা সড়ক থেকে রাসেল ভাইয়ের টিলায় পৌঁছতে বেশ দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হয়। কোথাও কোনও ছায়া নেই। দীর্ঘ জায়গাই বৃক্ষহীন নগ্ন টিলাপথ। অসভ্য মানুষ জঙ্গল উজাড় করে দিয়েছে। বনজ বৃক্ষের কাটা গোড়াগুলো আত্মঘাতি মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণাভরা ভেঙচি কাটছিল। প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন, পাম–কাসাভা চাষের মতো মনোকালচারের নগ্ন প্রয়াস প্রকাশ্য দৃশ্যমান। দেখার কেউ নেই। দীর্ঘ কাটফাটা রোদে যখন পিটাছড়া জঙ্গলে ঢুকি, তখন মনে হয়েছিল নরকের ময়দান পাড়ি দিয়ে স্বর্গে ঢুকে পড়েছি। আট–নয় বছরের নবীন প্রাকৃতিক জঙ্গলটি বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। বাস্তুহীন প্রাণিকুলের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে পড়েছে পিটাছড়া জঙ্গল। রাসেলভাই প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গাছগুলোর বাইরে কোনো গাছ লাগান না। ফলে নানা রকমের বনজ বৃক্ষের সমাহার। নানান গাছ নানান প্রজাতির প্রাণীদের আশ্রয় ও খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। সেবার একটা মজার দৃশ্য কারওরই চোখ এড়ায়নি। সেটা ঝন্টু আর রাসেল ভাইর রসায়ন। ঝন্টুকে, ঘুম পারানো, খাওয়ানো, স্নান করানো থেকে শুরু করে সব কিছুই রাসেল ভাইয়ের রুটিনওয়ার্ক। তিনি যেদিকেই যাচ্ছেন তার কোলে–কাঁধে করে ফিরছে ঝন্টু। ঝন্টু কোনও মানুষের সন্তান নয়, বানরের বাচ্চা। শিকারীদের হাতে মা–বাবা খুন হয়েছে। অল্প কয়দিনের নবজাতক এই বানরছানাকে ফিডারে করে দুধ খাইয়ে, ফলের জুস খাইয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। এরকম অনেক প্রাণীরই জীবনদাতা তিনি। গড়ে তুলেছেন ভলান্টিয়ার শ্রেণি, যারা দুর্যোগে আক্রান্ত প্রাণীদের জন্য কাজ করে। মানুষের জন্য পাঠাগার ও ক্লিনিকের স্থাপন করেছেন। বৃক্ষনিধন ও শিকার নিরুৎসাহিতকরণ এবং প্রাকৃতিক বনায়নে উৎসাহ প্রদান করতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সারাবছর। তাঁকে নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যায়, স্রেফ মানুষ হিসেবে নয়, প্রাণী হিসেবে, পৃথিবীর সন্তান হিসেবে সকলের প্রতি আমাদের কতখানি সচেতন ও দায়িত্বশীল জীবনবোধের প্রয়োজন।











