গল্পগুলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নয়

জয়দেব কর | সোমবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চন্দ্রনাথ পাহাড়। অনেক গল্প তাকে ঘিরে। শৈশবেই শুনেছিলাম তাকে ঘিরে নানা চমকপ্রদ বিবরণ। একবার বন্ধুদের কোনও একজনের মুখ থেকে যখন প্রথম এই পাহাড়ের গল্প শুনি তখন বিষয়টা তাৎক্ষণিক মেনে নিতে পারিনি। বিষয়টা আমার কাছে এরকম ছিল, এমন কোনও পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার নাম আমি জানি না, আমার বন্ধুরা জানে! ঘরে ফিরে যখন ছোড়দিকে জিজ্ঞেস করি, দেখি সেও চন্দ্রনাথের খবর জানে। যেনতেন খবর নয় একদম তীর্থযাত্রীদের মতো করে জানে। ছোড়দি জানে অথচ আমি এর বিন্দুবিসর্গই জানি না, বিষয়টা মোটেও মেনে নিতে পারছিলাম না৷ আর সেদিনের গল্পের আড্ডায় এটাও চোখে পড়েছিল যে অন্য বন্ধুরাও এই পাহাড়ি তীর্থের নাম বা গল্পের সাথে পরিচিত । মনে মনে একটু আহত হলেও আবার এটা ভেবেও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, ব্যাটারা আমার আগে জানলে কী হবে, আমার দিদি কিন্তু আগ থেকেই জানে। যেহেতু দিদি আমাদের বড়ো, সেহেতু সে আগ থেকে জানার কৃতিত্বটা আমারও জন্মসূত্রে প্রাপ্য! সে রাতে ঘুমোবার সময় ছোড়দি গল্প শুরু করল। কী রোমাঞ্চকর বর্ণনা! ওই বর্ণনা যে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয় তা ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারবে না। মনে হচ্ছিল তীর্থযাত্রী যেন ছোড়দি নিজেই! উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে! হাঁটু কেপে ওঠে! কত উঁচু! বাপরে বাপ। আমি তখন দেখতে পাচ্ছিলাম লাঠি ব্যবহার করে সাঁ সাঁ করে ছোড়দি উঠে যাচ্ছে, সাথে আমিও! এমন দৃশ্য কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি কত রাত! একই গল্প শুনেছি বারবার! ছোড়দিও কতদিন ঘুমিয়ে পড়েছে গল্প বলতে বলতে। আমি হয়ত জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি তারপর? ছোড়দি আর আমি কাছাকাছি বয়েসের। আমি যখন ফোরে তখন সে এইটে। এখন তার কন্যাই হাইস্কুলগামী! আর আমার পুত্র প্রাথমিকে! চন্দ্রনাথের গল্পবলা বন্ধুদের মধ্যে কারা যে এখন কোথায় আছে তা জানি না। সংসারী হয়েছে সবাই। কেউ কি কখনও সত্যিসত্যিই চন্দ্রনাথে গিয়েছে কিনা জানি না। আমার ছোড়দি যে আজও যায়নি তা নিশ্চিত। সে এক পাক্কা গৃহিণী। তারপরও আমাদের বিশাল শৈশবপ্রান্তর থেকে ভেসে আসা স্মৃতিসুখ উঁকি মারে। আহা! কতশত কল্পনাভ্রমণ! হিমালয়উচ্চতার উপরে উঠে মেঘে চড়ে ভেসে বেড়ানো দিন!

সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ আমি। সমতলের মানুষ। আমার বাড়ি থেকে জেলা সদরের তুলনায় সিলেট শহর অনেক কাছে। শৈশবে তো আমাদের উপজেলার মানুষদের সুনামগঞ্জে সড়কপথে যেতে হলে সিলেট শহর হয়ে ঘুরে যেতে হতো, এখন অবশ্য জগন্নাথপুর থেকে সুনামগঞ্জে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। তো সুনামগঞ্জ জেলাশহর হলেও কোর্টকাচারি ব্যতীত আমাদের সিংহভাগ মানুষের সিলেটমুখিতা বেশি ছিল, এখনও একই। বুদ্ধিবয়সের শুরুতে সিলেট শহর আমার কাছে স্বপ্নপুরীর মতো এক জায়গা মনে হতো বিশেষত এর বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, ভাঙাটিকর, কাষ্টঘর ও টিলাগড়ের জন্য। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বিভিন্ন নিকটাত্মীয়ের বাস ওসব জায়গায়। তাদের বাড়িতে নানা পরবে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ও বেড়াতে যাওয়া আনন্দদায়ক ছিল। বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, টিলাগড় আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ববাহী এলাকা। কারণ ওই এলাকাগুলো ‘পাহাড়’সমৃদ্ধ। যদিও সবাই ‘পাহাড়’গুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘টিল্লা’ বলে, যা টিলা শব্দটির স্থানীয় উচ্চারণ। কিন্তু আমার শিশুমনে টিলাগুলোই পাহাড়ের মর্যাদা পেয়েছিল। ওই টিলাগুলোর মাথায় বাড়িগুলোতে হেঁটে উঠতে পারা বিশ্বজয়ের মতোই মনে হতো। উপরে আকাশ আর নিচে জনপদকিশোরমনে দিতো এক অনন্য প্রশান্তির দোলা। শহর থেকে গ্রামে ফিরলে আমার ‘পাহাড়’এর গল্প বন্ধুদের সাথে ভাগ করার কৃতিত্ব ও আনন্দ বড়োই নিখাঁদ ছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি: সলিল চৌধুরী