চট্টগ্রাম বিভাগের আদি মেটারনিটি হসপিটাল হলো আন্দরকিল্লাস্থ জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল। এ হাসপাতালের জন্ম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও পূর্বে। এ হাসপাতালটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট পরিচালিত একটি প্রকল্প। চট্টগ্রামবাসীর কাছে প্রকল্পটি তার মাদার সংগঠন জেলা ইউনিটের চেয়েও বেশি পরিচিত। হাসপাতালটি তার ভবনের ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ইউনিটকে ১.৫০ লক্ষ টাকা পরিশোধ করে থাকে। ১৯৭৩ সালের পিও ২৬ নং এর আর্টিকেল ৭.৩ মূলে জেলা পরিষদ সমূহের চেয়ারম্যানগণ পদাধিকারবলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট জেলা ইউনিটসমূহের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে হিসেবে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা–কর্মচারীগণ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে তাদের সিস্টার অর্গানাইজেশন মনে করে থাকে। এভাবেও বলা চলে বর্তমানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দুটি হাত। জেলা পরিষদ যদি তাঁর ডান হাত হয় তবে জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তাঁর বাম হাত। বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম ২৮ নভেম্বর ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব বুঝে পান মূলত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে।
এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তার অবিকল বংশধর রেখে যাওয়া। এটি একটি মানুষের জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে। একজন নারীর কুমারী জীবনের অবসান ঘটিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার জন্য কত শত আয়োজন এই ধরনীর বুকে। মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার মাধ্যমে নারী জীবনের পূর্ণতা পায়। আর নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মেটারনিটি চিকিৎসার ক্ষেত্রে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আদিকালের আতুঁড় ঘর হতে বর্তমান যুগের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওটি রুম, লেবার রুম, কেবিন, জেনারেল বেড, ইনকিউবেটর, এনএসইউসহ আরো কত কি ব্যবস্থা। বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া সিজারিয়ান সেকশন। তবে সিজার ও নরমাল ডেলিভারির অনুপাত নিয়েও হরহামেশা কথাবার্তা শুনা যায়। আজও জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির অনুপাত সিজারিয়ান সেকশনের তুলনায় বেশি। মাতৃত্বের সহজাত এ প্রক্রিয়ার অনুভূতি থেকেই চেয়ারম্যান মহোদয়ের হাসপাতালটিতে আত্মনিয়োগ।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহোদয়ের দায়িত্ব গ্রহণের সময় হাসপাতালের মাসিক আয় ছিল ৫০–৫৫ লক্ষের মত। হাসপাতালের ডাক্তার–নার্স, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রায় ৮ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া ছিল। তাদের হাসপাতাল কতৃপক্ষের নিকট দরখাস্ত দিয়ে এবং ম্যানেজ করে বকেয়া চাইতে হতো। করোনা মহামারী এবং ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় ইত্যাদির কারণে হাসপাতালটি এ অবস্থায় চলে এসেছিল বলে সবার ধারণা। এ বকেয়া বেতন ভাতা তারা আদৌ পাবেন কিনা নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু চেয়ারম্যান মহোদয়ের দায়িত্বের ১ বছর পর এখন মাসিক আয় ১.১০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এবং বর্তমানে কর্মকর্তা–কর্মচারী, ডাক্তার–নার্সগণের মাত্র ২ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে। সবাই একসাথে অধিকারের মত করে তাদের প্রাপ্য নিয়মিত বেতন ভাতার পাশাপাশি ৬ মাসের বকেয়া বেতন ভাতাও হাতে পেয়েছেন।
এ এক বছরে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হতে প্রায় ৫৩.০০ লক্ষ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে হাসপাতালের সার্বিক পরিবেশ উন্নত, রোগী বান্ধব, দুর্গন্ধমুক্ত, নিরাপদ ও আধুনিক করা হয়েছে। হাসপাতালের নিজস্ব আয় হতে প্রায় ১.০০ কোটি টাকা ১২ টি ডিলাক্স কেবিন তৈরি, ৭ টি নার্সিং ইনস্টিটিউটের ল্যাব নির্মাণ, ৪ ডি কালার আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন ক্রয়, ফটোথ্যারাপি মেশিন ক্রয়, জেনারেটর ওভার হোয়েলমেড করা, ওটি রুম ও বেডের সংস্কার, কেবিন ও করিডোরসমূহের সংস্কার, মাইক্রোস্কোপ ক্রয়, বেডশীট, দরজা– জানালার পর্দা ক্রয়, হাসপাতালের ভিতরে বাইরে রংয়ের কাজ সম্পাদন, নিরাপত্তার নিমিত্ত প্রধান ফটক নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে।
হাসপাতালে সকল ব্যয় ক্রস চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে যা পূর্বে ক্ষেত্র বিশেষে নগদে সম্পাদন করা হতো। সকল ক্রয় প্রক্রিয়ায় পিপিআর অনুসরণ করা হচ্ছে। আপ্যায়নের নামে সকল ব্যয় বন্ধ করা হয়েছে। জেনারেটর ও গাড়ির জ্বালানী ব্যবহারের ক্ষেত্রে লগ বইয়ের প্রচলন করা হয়েছে, এতে জ্বালানী ব্যয় অনেক সাশ্রয় হয়েছে। সভার সম্মানী প্রদান ১ বছর ধরে বন্ধ ছিল। হাসপাতালের গার্ড, সুপারভাইজারদের নির্ধারিত পোশাক পরিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। হাসপাতালের সেবার ক্ষেত্রে সকল ধরনের ডিসকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। সকল ক্রয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মহোদয়ের নিকট হতে অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে কর্মরত ১৯৪ জন ডাক্তার–নার্স, কর্মকর্তা– কর্মচারীদের সার্ভিস বইসমূহ কমিটি গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করা হয়েছে। কমিটি হতে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য ১৯ দফা সুপারিশ পাওয়া গেছে। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এসব সুপারিশের আলোকে নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল অনিয়ম দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূত পদোন্নতির মাধ্যমে যারা প্রাপ্যের অধিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছেন তা পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে গ্রেড অবনমন করা হয়েছে।
জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যনির্বাহী কমিটির প্রতি ৩ বছর পরপর নির্বাচনের বিধান রয়েছে। চট্টগ্রামে জেলা রেড ক্রিসেন্টের এ নির্বাচিনটি কোন সময় হয়েছে এ ধরনের কোন রেকর্ড পাওয়া যায় নি। সবসময় আলোচনার মাধ্যমে অথবা অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে কমিটি গঠনের কাজ সম্পাদন করা হতো। ২ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে সর্বপ্রথম সকল নিয়ম–নীতি এবং বিধি–বিধান অনুসরণপূর্বক অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইউনিটের এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পরে অনুষ্ঠিত হওয়াতে চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বিডিআরসিএস সদর দপ্তরের সম্মানিত ভাইস চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণ নির্বাচনটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা নির্বাচনটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এ নির্বাচনটি পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
হাসপাতালে পূর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ দায়সারাভাবে উদযাপন করা হতো অথবা একবারে উদযাপন হতোই না। বর্তমানে খুব জাঁকজমকের সাথে এসব দিবসসমূহ উদযাপন করা হচ্ছে। অত্যন্ত সফলতার সাথে ৬ষ্ঠ যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নার্সিং ইনস্টিটিউটের মেয়েরা প্রায় দিবসগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছে।
জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে শুধু পূর্বের ভাইস চেয়ারম্যানের স্থলে বর্তমান চেয়ারম্যান মহোদয় ছাড়া ডাক্তার–নার্স, কর্মকর্তা–কর্মচারী এমনকি কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যবৃন্দ পদে কোন পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ পূর্বের সকলেই স্ব স্ব পদে কর্মরত রয়েছেন। বৃদ্ধি করা হয়নি কোন সেবার মূল্যও। বর্তমানে রোগীর সংখ্যা ৬০–৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে সেবার মান, রোগী এবং তাদের স্বজনদের সাথে ব্যবহারে এসেছে গুণগত পরিবর্তন। চট্টগ্রামবাসীর আস্থাও বেড়েছে পূর্বের তুলনায়। শুধুমাত্র নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার কারণে ১ বছরের মধ্যে এতসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। এসব অর্জন যেন টেকসই হয়– এটাই সকলের প্রত্যাশা। হাসপাতালটিতে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার এ অভিযাত্রায় চট্টগ্রামের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক : নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম