গণ সচেতনতা তৈরির দায়

কামাল পাশা | শুক্রবার , ১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

একটি পরিবারে সত্য চর্চা হলে শুদ্ধ হয় পরিবারটি। এতে উদ্বুদ্ধ হয় পাশের পরিবার। এভাবে সমাজ, মহল্লা, এলাকা ছাড়িয়ে সত্য ও শুদ্ধতার সুরভিত আলো দেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। পৃথিবীর সুখী, উন্নত, কল্যাণমুখী দেশগুলোতে তাই হচ্ছে। উদাহরণ টানলে কয়েক ডজন দেশের নাম বলতে হয়। সম্ভব না, অত স্পেস বরাদ্দ নেই। নিউজিল্যান্ড, স্ক্যানডেনেভিয়াসহ পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশকে মডেল ধরতে পারি। এসব দেশে ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ মিথ্যা বলে না। বলার দরকারও হয় না। মিথ্যা নেই মানে লোভ, বঞ্চনা, শঠতা, প্রতারণা কিছুই নেই। এসব খারাপ উপাদান না থাকলে সমাজ বা দেশ শুদ্ধির জন্য বাড়তি ক্লেশেরও দরকার নেই। শিক্ষাটা কিন্তু পারিবারিক। বাপ-মা মিথ্যা না বললে সন্তান মিথ্যা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেই। মিথ্যামুক্ত মানুষ খারাপ কাজ করতেই পারে না। করলে আরও বেশি মিথ্যার ঢাকনায় দুষ্কর্ম আড়ালে রাখতে হয়। না হলে উপযুক্ত শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না। এমন হলে তো সত্য চর্চা বিঘ্নিত হবেই। একবার মিথ্যার আবাদ শুরু হলে পুরো দেশ মিথ্যার জঞ্জালে ডুবতে বেশি দেরি হয় না। কারণ জঞ্জালের আবাদ বেজায় উচ্চ ফলনশীল।
প্রশ্ন, আমরা কী করছি? আসুন উত্তরটা নিজে খুঁজে নিই। বিবেক ‘টিউন’ করলেই সঠিক উত্তর পেয়ে যাবো। বিবেক যদি মৃত হয়, উত্তর মিলবে হ্যাঁ সূচক এবং প্রবলভাবে। মিথ্যার এঁদো ডোবায় ডুবে থেকে নাক উঁচিয়ে বলবো, ‘আমি কখনো মিথ্যা বলি না! সদা সত্য কথা বলি। আমার বউ, ছেলে-মেয়ে, পছন্দের জনরাও সত্য কথা বলে’। মৃত বিবেককে জীবন দেয়ার চিকিৎসা নেই। অতএব, ফলাফল অশ্বডিম্ব! মানে আমরা সবাই সত্যবাদী ও ধর্মানুরাগী! ধর্মও পালন করি-সত্য চর্চাও করি! মানে মুকুটে ‘ডাবল ক্রাউন’! আসলে ক্রাউন না কি কাকতাড়ুয়ার জরির ছেঁড়া পাগড়ি, বোঝার মত বিবেচনাবোধ নিজের নেই। অনুভূতি পুরোই ভোঁতা! বিবেকের মৃত্যু হলে এটা স্বাভাবিক। এমন ‘স্বাভাবিক অনুভূতি’ নিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, সন্তান বড় করছি। সেও আমার চর্চা ও অনুভূতি পায় উত্তারিকারসূত্রে।
না, আলোচনা তাত্তিক নয়, সহজ, সরল। আমরা কখনো নিজের চর্চাকে বিবেকের কষ্টিপাথরে যাছাই করি না বলে বেসুরো লাগতে পারে। লুকানো বিবেক বেটা দূরেই থাক। অবশ্য কেউ যদি এর মাঝে সুড়সুড়ি অনুভব করেন, বলতে দ্বিধা নেই-তার বিবেক এখনো ‘বগার পরাণ’ হয়ে বেঁচে আছে। তিনি আত্মানুসন্ধান করুন, ততক্ষণে ফিরে আসছি মূল প্রসঙ্গে। জানেন তো, চাঁদের প্লট বেচাকানা হচ্ছে, তাও নামমাত্র দামে। এক প্লটের দাম মাত্র ৪৫ মার্কিন ডলার! প্রথমে ভারতের এক ব্যক্তি বউকে বিবাহ বার্ষিকীর চমক চাঁদের প্লট উপহার দেন। বউটি খুশির উর্ধ্বচাপে ডগোমগো! চমকপ্রদ খবরটি কোটি কোটি রূপির প্রচার পেয়েছে মিডিয়ায়। দেখে আমাদের খুলনার এম ডি অসীমও প্রিয়তমা স্ত্রী ইশরাত টুম্পাকে ৬ষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকীর উপহার দিয়েছেন চাঁদের জমি। জমি মানে ডিজিটাল ম্যাপ, স্যাটেলাইট ছবি ইত্যাদি। তাও ৪৫ ডলার দামে! এমডি অসীম কোন এক বেসরকারি টিভি’র স্থানীয় প্রতিনিধি। ভারতীয় জমিদাতার অনুসরণে তিনিও মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপ প্রতিষ্ঠিত ‘লুনার অ্যাম্বেসি’ থেকে অনলাইনে জমি কিনেছেন। কী কপাল, মাত্র ৪৫ ডলারেই ফাটাফাটি কাণ্ড! আমাদের বাঘা বাঘা ইউটিউব, ফেবু সেলিব্রিটিদের ঘাড়ধাক্কায় কাত করে অসীম-টুম্পা দম্পতি ভাইরাল আইটেম! সব মিডিয়ায় শিরোনাম দখলে নিয়েছেন। ৪৫ ডলারে কোটি কোটি টাকার প্রচার, ভাবা যায়! আরো বড় ইতিবাচক বার্তা, অস্বাভাবিক স্ত্রী নির্যাতন, যৌতুকের জন্য খুনের ঘটনা মিডিয়ায় দেখে চোখে ছানি পড়ার সময় স্ত্রী-প্রেমের স্বর্গীয় প্রস্রবিনী ধারায় আনন্দাশ্রুর বান নামবেই তো!
মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে কিন্তু চিরতার তেতো গিলাতে হচ্ছে। অমর কথাশিল্পী সৈয়দ মুসতবা আলীর রচনায় প্যারিসের কোন এক অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি বিক্রির কথা আমরা জেনেছি। দেশিয় রাজা বাহাদুর নিজের ও রাণীর ডক্টরেট কিনে প্রিয় ঘোড়ার জন্যও কিনতে চেয়েছিলেন। খুবই রসজ্ঞ পরিবেশনা। এখন এসব ডিগ্রি, সনদ, পদক, সম্মাননা, ভিউ রেটিং বেচাকানার বাজার আরো বিশাল এবং রমরমা। উন্নত দেশগুলোর প্রতারকচক্র লোভনীয় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দেদারছে। কিনছে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের কিছু চালু চক্র। ডিজিটাল প্লাটফর্মে ব্যবসাটার ব্যাপ্তি ও সংক্রমণ ভয়াল। ব্যক্তির বাইরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অনলাইন পোর্টাল, আইপি টিভিও প্রতারণা চেইনের আঙটা এবং পেইড ভোক্তা। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। প্রতারকদের বিজ্ঞাপনী ফেনায় ভাল-মন্দ বুঝতেও অক্ষম। নতুন সংযুক্ত হলো, ডেনিস হোপের ‘লুনার অ্যাম্বেসি’। নভোযান অ্যাপেলো-১১ প্রথম চাঁদে মানুষ নামানোর পর আধা শতাব্দীতেও কোনো নভোযান চাঁদে মানুষ নামায়নি। তাহলে এরা কারা? কীভাবে বা কোন দখলসত্ত্বে চাঁদে মাত্র ৪৫ ডলারে প্লট বিক্রি করছে? চটকদার খবরটির প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় না নিয়ে মিডিয়াগুলো হুলস্থুল কাভারেজ দিয়েছে! এতে প্রতারক চক্রের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠলে ক্ষতিটা কার? দায়িত্বশীল মিডিয়া নিজস্ব প্রতিনিধির পাঠানো জনগুরুত্বপূর্ণ খবরও যাছাই-বাছাই করে প্রকাশ করে। এটাই পেশাদারিত্বের দায়। তাহলে অন্য এজেন্সির তৈরি বিদেশি প্রতারক চক্রের স্বার্থঘনিষ্ঠ চটকদার খবর যাছাই বাছাই ছাড়া প্রকাশ কি উচিত? এতে মিডিয়া দায়বদ্ধতার উপর কিন্তু আঁচড় পড়ছেই। যে যাই বলুক, সত্যনিষ্ঠ সুস্থ জাতি গঠনে মিডিয়ার দায় বিশাল।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১২২.৯৮ কোটি টাকা