বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও অবাক ব্যাপার হলো যে বাংলাদেশে এখনো গণমুখী, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মেধা ও উৎপাদনমুখী সর্বজনীন একটি শিক্ষানীতি বিদ্যমান নয়। স্বাধীনতার পর পরই এদেশে প্রথম শিক্ষানীতিটি ড. কুদরত–ই–খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট হিসেবে পরিচিত হলেও অজ্ঞাত কারণে এটি বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থাটি তিনটি স্তরে বিভক্ত এবং কোনোটি সর্বজনীন ও গণমুখী নয়। কেননা আমরা দেখি যে এদেশে মাদ্রাসা ও কওমী শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে বিভক্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ নিচ্ছে। অর্থাৎ এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণি বিভক্তিও বৈষম্যমূলক চেহারা সুষ্পষ্ট। ফলে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণিগত অবস্থান অনুযায়ী মানুষ তৈরি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলামে; যা কখনো অভিন্ন মানব সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। বিগত বছরের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও জীবিকার সংস্থান–কিন্তু আসলে তা কি হয়েছে? শিক্ষাক্ষেত্রে যে বৈষম্যটি জুলাই অভ্যুত্থানের আগে যা ছিল তা থেকে উত্তরণ ঘটেছে কি? আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষা পাঠক্রম এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বইপত্রে কী বিষয়গুলো স্থান পাবে এবং কোন বিষয়গুলো নতুনভাবে সংযুক্ত হবে সেক্ষেত্রে এখনো একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার জায়গায় এই শিক্ষা ব্যবস্থাটি দাঁড়াতে পারেনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখনো শিক্ষা পাঠক্রমের সবকটি বই পায়নি। তাই নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা অনেকেই সরকারি বই ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। এমনকি অনেক শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিমুখ হয়ে পড়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার স্থিতি নড়বড়ে। এই অবস্থার স্থায়িত্ব চলমান থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বন্ধ্যাত্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। পতিত সরকারের আমলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের যে উদ্যোগটি শুরু করেছিল তা নিয়েও নানান প্রশ্ন ছিল। কেননা তৎকালীন সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টা চালালেও সুষ্পষ্ট কোনো নীতিমালা ছাড়াই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত লক্ষ্যহীন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছে; যার ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।
আমরা অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে খুব বেশি আশা করতে পারি না। কেননা তারা একটি প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে খুব একটা বেশি সময় পাবেন না। তাই এইটুকু অন্তত তারা করতে পারেন যে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের জট ও অচলায়তনের সৃষ্টি না হয় সেক্ষেত্রে একটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এমন একটি রোড ম্যাপ দেবেন যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে গতিশীলতা চলমান থাকে। পাশাপাশি বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষের অপচয় না ঘটে এবং শিক্ষাবর্ষটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাধাহীনভাবে অগ্রসর হতে পারে।