১৯৮২ সালের স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের অপশাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় সুজিত চক্রবর্ত্তী সরকারি কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী। সেই সময় তাঁর এক বন্ধু তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও গণসঙ্গীত শিল্পী অশোক সেনগুপ্তের সাথে। প্রয়াত অশোক সেনগুপ্তের নির্দেশনায় সংগ্রামী গানের তৎকালীন জনপ্রিয় একটি পথনাটক ‘সর্বনাশী রাজাবলী’-তে তিনি যুক্ত হলেন ঢোল বাদক হিসেবে। ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছেন সঙ্গীতের আবহে। মৃদঙ্গ বাজিয়ে কীর্তন দলের সঙ্গেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সঙ্গীত এবং নাটকে অনুরাগ কৈশোর থেকেই। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০-এ দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে, মিছিলে গানের দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ, চট্টগ্রামের গণসঙ্গীত সংগঠন ‘আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী’র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকার সুবাদে সুজিত চক্রবর্ত্তী একদল তরুণ শিল্পীর সমন্বয়ে গড়ে তুলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন-অভ্যুদয় সঙ্গীত অঙ্গন। ১৯৮৮ সালের ১ বৈশাখ নাট্যজন একুশে পদকে ভূষিত আহমেদ ইকবাল হায়দারের নেতৃত্বাধীন ‘তির্যক’ নাট্যদলের মাধ্যমে যুক্ত হন মঞ্চ নাটকে। নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগঠনের কাজ করে গেলেও জীবন-জীবিকার তাগিদে এক সময় ভাটা পড়ল অভ্যুদয় সঙ্গীত অঙ্গনের কাজে।
২০১২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা দেবাশীষ গুহ বুলবুলের প্রেরণায় তিনি পুনরায় সঙ্গীত-সংস্কৃতিপ্রেমী কিছু উদ্যমী শিল্পী-সংগঠকদের একত্রিত করে পাথরঘাটা পূজা মন্দিরে আয়োজন করলেন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। পরপর কয়েক বছর এ ধরনের উদ্যোগের সাফল্যের মাঝে জন্ম নিল গণমানুষের গান নিয়ে নতুন একটি সংগঠন ‘সৃজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গন’। এ কাজে প্রেরণা যুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক শিউলি ঘোষ এবং তাঁর দীর্ঘদিনের বেড়ে ওঠার স্থান পাথরঘাটার সংস্কৃতিপ্রেমী বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা।
২০১৫ সালের পর থেকে সৃজামি মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে আয়োজন করেছে ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস এবং মে দিবস স্মরণে অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠিত হয়েছে সঙ্গীত বিষয়ক কর্মশালা, সঙ্গীত শিক্ষার নিয়মিত কার্যক্রম। এ ক’টি বছরে সৃজামি, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি এবং বাংলা নববর্ষে ডিসি হিল এবং সিআরবির শিরীষতলায় ঐতিহ্যবাহী সমাবেশে নিয়মিত গণমানুষের গান, কবিতা থেকে গান পরিবেশন করে চলেছে।
গণসঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি সুজিত চক্রবর্ত্তী সুরারোপ করেছেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবিদের কালজয়ী কিছু কবিতা- ‘কবিতা থেকে গান’ শিরোনামে। প্রয়াত গণসঙ্গীত শিল্পী অশোক সেনগুপ্ত এবং বাংলা গানের প্রবাদ প্রতীম সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্মরণে সৃজামি আয়োজিত অনুষ্ঠান শ্রোতামণ্ডলীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনি ১০টি কবিতায় সুরারোপ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি গান বিদগ্ধ শ্রোতাদের কাছে বহুল প্রশংসিত হয়েছে এবং এটি সৃজামি আয়োজিত গণসঙ্গীতের উৎসবে অন্য একটি মাত্রা যুক্ত করেছে। এরই মধ্যে সুজিত চক্রবর্ত্তী তাঁরই রচনা ও সুরে চারটি গান পরিবেশন করে নন্দিত হয়েছেন। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর সৃজামি অনলাইন-ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মানুষের কাছে। অনলাইনে সৃজামি ২০২০-২১ সালে বিজয় দিবস, ভাষা শহীদ দিবস এবং মে দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান করেছে।
সৃজামি আয়োজিত উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে ঢাকার গণসঙ্গীত সংগঠন অগ্নিশিখা, যশোর উদীচী, চট্টগ্রাম উদীচীসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় গণসঙ্গীত সংগঠন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সৃজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গন জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রামে আয়োজন করেছে তিন দিনের গণসঙ্গীত উৎসব। উৎসবে দেশের সঙ্গীত অঙ্গনের স্বনামধন্য শিল্পী, সংগঠন, সংগঠকরা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গীতিকার কবি ও গণমানুষের শিল্পী বিপুল চক্রবর্ত্তী এবং শিল্পী অনুশ্রী চক্রবর্ত্তী অংশগ্রহণ করেন। উৎসবে অনুষ্ঠিত হয়েছে সঙ্গীত বিষয়ক সেমিনার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের সম্মাননা এবং এ অঙ্গনের গুণীজনদের সম্মাননা জ্ঞাপন। শুদ্ধ সঙ্গীত ও গণমানুষের সুখ-দুঃখ গাঁথার সঙ্গে একাত্মতা এবং বিপুল সংখ্যক শ্রোতা, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রেরণা-ই সৃজামির পথ চলার পাথেয়।