তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে গণমাধ্যম কমিশন। আগামী সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। তথ্য ভবনে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। আলোচনায় বক্তারা সংবাদপত্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনার জন্য মিডিয়া কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা বলেন, এই আন্দোলনে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে কিছু গণমাধ্যমকর্মী ফ্যাসিবাদের পক্ষে ছিলেন। যারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি অবিচার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি মিথ্যা মামলা হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রত্যাহার করা হবে। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে কেউ যেন ফ্যাসিবাদের পক্ষে কথা না বলেন, সে বিষয়ে তিনি সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, গণমাধ্যম হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যা দেশের আপামর জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন রকমের গণমাধ্যমের দ্বারাই মানুষ নেপথ্যে থাকা সংবাদ সম্পর্কে অবগত হতে পারে। উন্নয়ন ধারায় এ মাধ্যম একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
সকল সভ্য দেশেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও ভূমিকা স্বীকৃত। তা শুধু সংবাদ পরিবেশনের জন্যে নয়, দেশ ও জাতির নানা সংকটময় সময়ে– উত্থান– পতনে জনমত গঠনেও সংবাদপত্র পালন করে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। বর্তমান বাংলাদেশে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে আরও বেশি হারে। ফলে দেশের সংবাদপত্রগুলো অবতীর্ণ হয়েছে পাঠককে তুষ্ট করার বিশেষ আয়োজনে। শুধু সংবাদ নয়, নানা ফিচার পাতা সংযোজন করে এবং অনেক সময় সপ্তাহে দুতিন দিন মিনি ম্যাগাজিন মূল পত্রিকার সাথে পাঠকের কাছে সরবরাহ করে পত্রিকাগুলো পাঠকের মন জয় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতাকে নেতিবাচক হিসেবে আমরা নিতে চাই না, বরং পাঠকরা ক্রমশ এতে লাভবান হচ্ছেন। পত্রিকা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে প্রতিযোগিতা এবং পাঠক তাতে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। একটি ঘটনা, যা কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত হয়েছে, তা পাঠকের সামনে সংবাদ আকারে পৌঁছাতে সংবাদপত্রকে আগামী ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সংবাদটি তাদের দর্শক–শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অত্যন্ত স্বল্প–সময়ে। সময়ের বিবেচনায় এই মাধ্যমটি অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তবু তীব্র ও অসম প্রতিযোগিতার মুখে সংবাদপত্রগুলো পিছু হটছে না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তাৎক্ষণিক খবর পরিবেশনার সুযোগটিকে মাথায় রেখে তারা পরিবেশন করছে বিস্তারিত সংবাদ এবং সংবাদের পেছনের সংবাদ। ফলে সংবাদপত্রগুলো এগিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে এবং পাঠকের কাছে হচ্ছে আরও নন্দিত ও প্রিয়। সামপ্রতিক সময়ে আলোড়ন তুলেছে অনলাইন সাংবাদিকতা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ মাধ্যম।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অনলাইন সাংবাদিকতার নামে বিচ্ছিন্নভাবে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। সবচেয়ে বিশ্বস্ত গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনেও ভুল তথ্যসংবলিত খবর বা ভুয়া খবর প্রচার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই বিশ্বাসযোগ্য সংবাদসূত্রের ব্যবহার এবং ‘ভুয়া খবর’–এর বিস্তার বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন মূলধারার সংবাদকর্মীরা। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো ব্ল্যাকমেইল করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করা। মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সেই সংবাদ আবার প্রত্যাহার করে নেওয়ার দৃষ্টান্তও প্রচুর। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টার্গেট করে একেকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করার অপতৎপরতা লক্ষ্যণীয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যম কমিশন গঠন করে শুরুতেই সাংবাদিকতার নামে যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুয়া সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজি করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
মিডিয়া আজ মুক্ত, তার পরিধি আজ পৃথিবীব্যাপী। সব জাতি, সমাজ ও বিশ্বপরিমণ্ডলকে প্রভাবিত ও অবগত করে মিডিয়া। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উত্তরণ ও বিস্ময়কর অগ্রগতিতে মিডিয়ার যে বিস্তার ঘটেছে, তা কল্পনাতীত। সাংবাদিক সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, অন্যায়–অবিচার–শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধাচরণ, দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষাবলম্বন এবং নৈতিক আদর্শে অবিচল এমন মানুষ বা পেশাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা, আমরা জানি সমাজে সুশাসনের সমস্ত ধারণাই শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম দ্বারা পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিকের মধ্যে রয়েছে : সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার মূল্যায়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে সম্যক ধারণা প্রদান, অবাধ তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করা। আশা রাখি, গণমাধ্যম কমিশন গঠিত হলে বিদ্যমান সমস্ত দুরাচারের অবসান হবে।