গণমাধ্যমে সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ করা দরকার। খবর সেন্সর করা বা খবর বিক্রি করা, এগুলো সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করছে। সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা নেই কথাটা ঠিক না। অনেকগুলো নীতিমালা রয়েছে। যদি আমরা বলি যে, সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই, সেটা সত্যি কথা। সারা দেশে সম্পাদকীয় মান, একটা অভিন্ন ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিৎ, কিন্তু সেরকম কিছু নেই। সেটার বিষয়ে আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি যে, আসলে একটা জাতীয় নীতিমালা হওয়া দরকার। পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে অনেকগুলো নীতিমালা আছে, সমস্যা হচ্ছে, সরকার সেগুলো মানেনি। পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রশ্ন থেকে শুরু করে সবকিছুর নীতিমালা রয়েছে। ৮ পাতার একটি পত্রিকা বের করতে গেলে সম্পাদকের ন্যূনতম ৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, সেটি নীতিমালায় রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে যে, অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকারসূত্রে ভাইকে সম্পাদক বানাই দিল, পুত্রকে সম্পাদক বানাই দিল। সেটি আবার সরকার গ্রহণ করেছে এবং সেটি রাজনৈতিক প্রভাবেই। গতকাল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সাথে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে কামাল আহমেদ এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম বিভাগের ৮টি জেলার সাংবাদিকরা সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তারা একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরেন। বক্তব্যে কামাল আহমেদ বলেন, চট্টগ্রামের কথা বলতে পারব না, এটির হিসেব নেই। কিন্তু ঢাকারটা দেখেছি। ঢাকায় দুটি সমিতির মাধ্যমে সংবাদ বিলি হয়। এ দুটি সমিতির হিসাবের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ঢাকা শহর থেকে ৩০২টি পত্রিকা বের হয় আর পুরো বাংলাদেশ থেকে বের হয় ৫৯২টি। আমরা দেখেছি, মাত্র ৪৬টি পত্রিকা সমিতি লেনদেন করে। বাকী কাগজগুলো কেউ নেয় না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের একারই চারটা পত্রিকা। ৬ হাজারের কম সার্কুলেশন কিন্তু দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার। একই ব্যক্তি পত্রিকা, টিভি, অনলাইন, রেডিওর মালিক হতে পারবে না। এমনকি আমেরিকাতেও একই ব্যক্তি পত্রিকা, টিভির মালিক হতে পারে না। আমাদের এখানে একই ব্যক্তিকে পত্রিকা ও টিভির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একই হাউসকে টিভি, পত্রিকা, অনলাইন, রেডিওর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পাঠক কী পাচ্ছে? একই জিনিষ দুটি প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হচ্ছে। ভিন্ন মত, ভিন্ন চিত্র, কোনো বৈচিত্র্য পাঠক দেখতে পাচ্ছে না। এগুলোর সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। যে কেউ পত্রিকা বের করে ফেলছেন উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, এগুলোকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা শুধু সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে না, টিভির ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে ৪৬টি টেলিভিশন চলার মতো বাজার নেই। এগুলোকে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। যেহেতু বাজার নেই, এসব টেলিভিশন আয়ও করতে পারে না, আবার নিয়োগ দেয় বিনা বেতনে। এসবকে কেন্দ্র করে একটা দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। এ দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।
সারা দেশে সাংবাদিকতার জন্যে নূন্যতম বেতন নির্ধারণ একটা ভালো সমাধান হতে পারে উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, রাজধানীর জন্য একটু বেশি নির্ধারণ করতে হবে। সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। কামাল আহমেদ বলেন, যারা ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা, যারা ফ্যাসিবাদকে উসকানি দিয়েছেন, উদ্ভুদ্ধ করেছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন এসেছে। সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনো তদন্ত সংস্থা না। আমরা কোনো অপরাধের তদন্ত করতে পারব না। তদন্ত করার এখতিয়ার আমাদের না। তবে হ্যা আমরা এটা বলতে পারি যে, যারা উসকানিদাতা তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে যে বৈষম্যগুলো করা হয়েছে, যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে, বৈষম্যের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্যক্তি হিসেবে সাংবাদিক যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। হয়রানিমূলক মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জেল কেটেছেন, দিনের পর দিন কাজ করতে পারেননি, সে ব্যক্তিদের মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়টা আসলেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই করা দরকার। তিনি বলেন, প্রেস ক্লাবের বিষয়টা কিভাবে সমাধান করা যায় সেটা আমাদের ভাবতে হবে। প্রেস ক্লাব আসলে একেবারেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি সদস্যদের ক্লাব। সমাজসেবা অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এটি চলে। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা একটা ভিন্ন জিনিষ। সেটার সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রকে শক্তিশালী করার প্রশ্নটা সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। এ সমস্যার সমাধান আসলে আমাদের জানা নেই। এমনও উপজেলা আছে যেখানে চারটা প্রেস ক্লাব রয়েছে। এটা হচ্ছে আসলে ক্ষমতার দল। প্রেস ক্লাব করলে বোধ হয় কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। প্রেস ক্লাবের নেতা হইলে একটু আলাদা মর্যাদা, একটু আলাদা আর্থিক কোনো ব্যাপার থাকতে পারে। এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে তা আমাদের জানা নেই, আমরা তা করতে পারব না। আমরা বলতে পারি যে, কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায় তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কামাল আহমেদ আরো বলেন, আপনারা আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সৎপ.ঢ়ড়ৎঃধষ.মড়া.নফ এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত বা সুপারিশ কমিশনের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। আপনাদের প্রেরিত মতামত বিবেচনা করে কিভাবে গণমাধ্যমে সংস্কার আনা যায় এ বিষয়ে কমিশন সুপারিশ পেশ করবে।
কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, কামরুন্নেসা হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সবুজ, চট্টগ্রাম পিআইডির উপপ্রধান তথ্য অফিসার মো. সাঈদ হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের একগুচ্ছ সুপারিশ :
সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে। বিগত বছরে যেসব সাংবাদিকের নামে ‘মিথ্যা’ মামলা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। গত পনের বছরে যেসব ভুয়া পত্রিকা নিবন্ধিত হয়ে ডিএফপির তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোকে বাদ দিতে হবে। পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগদান করতে হলে সাংবাদিকতায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বা সাংবাদিকতায় পেশাগত ডিগ্রি থাকতে হবে। উপজেলা এবং মফস্বল এলাকার প্রেসক্লাব সভাপতি ও সম্পাদককে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য নির্বাচিত করা এবং মফস্বল সাংবাদিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে সাংবাদিক লেখা স্টিকার ব্যবহার করে ভুয়া সাংবাদিকেরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে আসছে। এসব ভুয়া সাংবাদিকতা বন্ধের নিমিত্তে প্রেস ইনিস্টিটিউটে ডিপ্লোমা চালুকরণ বা সাংবাদিকদের মান উন্নয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের একক রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান ও তাদের সরকারি পরিচিতি নিশ্চিত করতে হবে। ফলে একজনের একাধিকবার সরকারি সুবিধা প্রাপ্তি বন্ধ হবে। পাশাপাশি পিআইডির তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ জন্য পিআইডিকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। কামাল আহমেদ বলেন, সংবাদপত্রকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করার জন্য এ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান লক্ষ্য থাকবে সংবাদ প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।