গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হতে পারে এমন বিতর্কিত ও সমালোচিত আইন পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল রোববার তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবার দপ্তরে এসে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে এক গুচ্ছ সংস্কারের কথা বলেছেন বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক। প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে আনা হয়েছিল নাহিদকে। পরে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয় ২৬ বছর বয়সী এই তরুণকে। প্রথম দিন দপ্তরে এসে কর্মকর্তা এবং সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেখানে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনে সরকারের প্রাথমিক ভাবনার কথাও বলেন। খবর বিডিনিউজের।
মতবিনিময়ের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ছাত্র, জনতা এবং সাংবাদিকদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নাহিদ বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হয়েছে। ফিডম অব প্রেস যদি না থাকে, ফ্রিডম অব স্পিচ কিন্তু ঠিক হয় না। সেই জায়গায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় আমাদের কাজ করতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, কি হচ্ছিল কিছুই জানা যাচ্ছিল না তখন। তথ্যের কোনো প্রবাহ ছিল না। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিন্তু সম্পূর্ণ সরকারের করায়ত্তে ছিল। আমাদের কোনো বক্তব্য সে সময় প্রচার করা হতো না। এটা আমি ব্যক্তিগত অভিমত থেকে বলছি, আমাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য যেটা আমরা বলিনি বা মিসকোট করে প্রচার করা হতো। তারপরও সেই সময় আমরা দেখেছি যে, কিছু প্রিন্ট মিডিয়া আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে। আরও অনেক মিডিয়া আমাদের অনেকভাবে সাপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টাররা আমাদের সহযোগিতা করেছেন। হয়ত হাউজ বা মালিকের কারণে অনেক কিছু করতে পারেননি। আমরা চাই না এগুলো পুনরায় ফিরে আসুক।
গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেখানে যাতে জনগণের কথা তুলে ধরা যায়, এজন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন উপদেষ্টা। এ সময় তিনি বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি কোনো ধরনের দলীয়করণ দেখতে চান না।
স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা হবে : স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশনের কথা প্রাথমিকভাবে ভাবা হচ্ছে জানিয়ে নাহিদ বলেন, সাংবাদিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে বা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এ উদ্যোগ নিতে চাচ্ছি। বিদ্যমান যেসব আইন আছে, সেগুলোতে যদি সংস্কার আনার প্রয়োজন মনে হয়, সেগুলো আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা উদ্যোগ নেব।
তথ্য ও সম্প্রচার নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সমালোচনা না আসে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন বলে জানিয়েছেন নাহিদ। গণমাধ্যম সূচকে উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম সূচকে আমরা অত্যন্ত নিচের দিকে ছিলাম। দক্ষিণ এশিয়াতে আফগানিস্তানের পরে আমাদের সূচক ছিল। এ বিষয়গুলো আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতে হবে।
সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ বলেন, আন্দোলনের সময় গণহত্যার ছবি এবং ভিডিও প্রকাশে সহযোগিতা করা হবে এবং এগুলোর মাধ্যমে আহত এবং নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা এবং পরিচয় জানা যাবে। তাই এই তথ্যগুলো দিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সহযোগিতা করার জন্য উপদেষ্টা অনুরোধ করেন। এছাড়া আন্দোলনে হতাহত সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
নাহিদ বলেছেন, নির্দোষ, নিরপরাধরা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয়, সেটি দেখতে উপদেষ্টাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। মামলা হলে সুস্পষ্ট তদন্তের ভিত্তিতে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের বেতন কাঠামো নিয়ে নীতিমালা প্রয়োজন বলে মনে করেন নাহিদ। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বেতন কাঠামো নিয়ে অনেক অসন্তোষ রয়েছে। আমরা যদি মেধাবীদের উৎসাহিত করতে না পারি তাহলে সাংবাদিকতা এগোবে না। যারা রিপোর্টার এবং জুনিয়র লেভেলে কাজ করে, তাদের বেতন অত্যন্ত কম, অনেক ক্ষেত্রে বেতন কাঠামো মানাও হয় না।
প্রহসন হয়েছে : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রহসন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তথ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বারবার এই মামলার প্রতিবেদন পেছানো হয়েছে। সাগর–রুনি হত্যাকাণ্ডসহ এ ধরনের যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সাংবাদিকদের ওপর যত নিপীড়ন হয়েছে এ বিষয়গুলোর তদন্ত করতে হবে এবং সরকারের জায়গা থেকে মন্ত্রণালয়ের জায়গা থেকে এ নিয়ে ভূমিকা পালন করব।
চলচিত্র নিয়ে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না : নাহিদ ইসলাম মনে করেন, চলচ্চিত্র নিয়ে আগামীতে আরো কাজ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের অনেক আকাঙ্ক্ষা চলচ্চিত্র নিয়ে, কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না। অনেকগুলো চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে আছে, যদি কোনো নীতিমালা ভঙ্গ না হয়, তাহলে দ্রুততম সময় চলচ্চিত্রগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি এবং ব্যক্তিগত পরিচয় যেন বিবেচনায় না নেওয়া হয় সে বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
মন্ত্রণালয়ের দপ্তর প্রধানদের উদ্দেশে নাহিদ বলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান মন্ত্রণালয়ে থাকবে না। বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করার যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, সেখানে যেন এ ধরনের স্বৈরতন্ত্র আর কোনোদিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
আমাকে স্যার ডাকার দরকার নেই : নাহিদ ইসলাম সাংবাদিক এবং দপ্তরের কর্মকর্তাদের বলেছেন, তাকে স্যার সম্বোধন করার কোনো প্রয়োজন নেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকাল সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, আমাকে স্যার ভাবারও দরকার নেই, স্যার বলারও দরকার নেই। একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, আমি আপনাদের সন্তান হিসেবে এখানে এসেছি, আমি জনগণের পক্ষ থেকে জনগণের দাবি–দাওয়া নিয়ে এখানে এসেছি। নতুন দেশ গড়তে সবার কাছে সহযোগিতা চান তিনি। বিশেষ কারণ ছাড়া তার ছবি প্রচার না করারও অনুরোধ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা নাহিদ বাবা–মায়ের সঙ্গে ঢাকাতেই বড় হয়েছেন। তার বাড়ি ঢাকার খিলগাঁও দক্ষিণ বনশ্রীতে। পরিবার আর কাছের বন্ধুরা তাকে ডাকে ‘ফাহিম’ নামে। নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম জামির একজন শিক্ষক। মায়ের নাম মমতাজ নাহার। দুই ভাইয়ের মধ্যে নাহিদ বড়।