গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বহুমাত্রিকতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিভিন্ন দিক রয়েছে। যেমন : সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, টেলিফোন ও মোবাইল। বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি বিস্ময়করভাবে বিসতৃত হয়েছে তার প্রভাব। এক সময় সংবাদপত্র প্রকাশ করা হতো দেশসেবার মিশন নিয়ে। ভিতরে লুকায়িত থাকতো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের কৌশল। এখন সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমকে দেখা হয় শিল্প হিসেবে। পুঁজি খাটাবো, মুনাফা অর্জন করবোএমন লক্ষ্য নিয়ে মিডিয়ায় পদার্পণ ঘটে সংবাদপত্র মালিকদের। প্রতিযোগিতা বাড়ছে, বাড়ছে সংবাদপত্রসেবী বা গণমাধ্যম কর্মীদের সংখ্যা।

সকল সভ্য দেশেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও ভূমিকা স্বীকৃত। তা শুধু সংবাদ পরিবেশনের জন্যে নয়, দেশ ও জাতির নানা সঙ্কটময় সময়েউত্থানপতনে জনমত গঠনেও সংবাদপত্র পালন করে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। বর্তমান বাংলাদেশে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে আরও বেশি হারে। ফলে দেশের সংবাদপত্রগুলো অবতীর্ণ হয়েছে অঘোষিত প্রতিযোগিতায়। শুধু সংবাদ নয়, নানা ফিচার পাতা সংযোজন করে পত্রিকাগুলো পাঠকের মন জয় করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতাকে নেতিবাচক হিসেবে আমরা নিতে চাই না, বরং পাঠকরা ক্রমশ এতে লাভবান হচ্ছেন। পত্রিকা যত বাড়ছে, তত বাড়ছে প্রতিযোগিতা এবং পাঠক তাতে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। একটি ঘটনা, যা কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত হয়েছে, তা পাঠকের সামনে সংবাদ আকারে পৌঁছাতে সংবাদপত্রকে আগামী ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সংবাদটি তাদের দর্শকশ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অত্যন্ত স্বল্পসময়ে। সময়ের বিবেচনায় এই মাধ্যমটি অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তবু তীব্র ও অসম প্রতিযোগিতার মুখে সংবাদপত্রগুলো পিছু হটছে না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তাৎক্ষণিক খবর পরিবেশনার সুযোগটিকে মাথায় রেখে তারা পরিবেশন করছে বিস্তারিত সংবাদ এবং সংবাদের পেছনের সংবাদ। তাছাড়া প্রতিটি সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্কারণ প্রকাশ করে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলছে। ফলে সংবাদপত্রগুলো এগিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে এবং পাঠকের কাছে হচ্ছে আরও নন্দিত ও প্রিয়।

মিডিয়া আজ মুক্ত, তার পরিধি আজ পৃথিবীব্যাপী। সব জাতি, সমাজ ও বিশ্বপরিমণ্ডলকে প্রভাবিত ও অবগত করে সংবাদপত্র। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উত্তরণ ও বিস্ময়কর অগ্রগতিতে সংবাদপত্রের যে বিস্তার ঘটেছে, তা কল্পনাতীত। যুগের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংবাদপত্র পৌঁছে যাচ্ছে গোলার্ধের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ আজ পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করছে। মিডিয়ার কণ্ঠরোধ বা নিয়ন্ত্রণ এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সংযোজনে। বলা যেতে পারে, মিডিয়া এখন পূর্বেকার সময়ের চাইতে বেশি স্বাধীনতামুখী, সার্বভৌমত্ব প্রত্যাশী ও শক্তিধর। এখানে সংকট আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, নিগ্রহনিপীড়ন আছে, শ্রমের শোষণ আছে; তবু নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, গণমাধ্যমের অগ্রগতি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

সংবাদমাধ্যম আজ বড় পুঁজির বড় শিল্প। প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ ছাড়া কোনো সংবাদপত্র বা মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তবে পুঁজি সফল সংবাদপত্রের একমাত্র উপকরণ নয়। ব্যবসা বা মুনাফা অর্জন যে কোনো শিল্পের জন্য প্রধান হলেও সংবাদপত্র শিল্পের জন্য একটু ব্যতিক্রম। এখানে মুনাফা আসবে, তার সাথে অবশ্যই থাকতে হবে দেশ বা জাতির সেবা। তা না হলে সাংবাদিকতা হবে লক্ষ্যচ্যুত। সৎ সাংবাদিকতার যে রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে প্রবহমান, তা বাধাগ্রস্ত হবে। যদিও সবসময় সাংবাদিকরা তাঁদের কার্যক্ষেত্রে সফল হন না, তবু তাঁরা তাঁদের কর্মে থাকেন অবিচল। এ বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যে সত্য উদঘাটন করেন সাংবাদিকরা, তার প্রতিক্রিয়া কী হয় সমাজে? কখনো কখনো তোলপাড় হয়ে যায়। পদত্যাগ করতে হয় বিচারককে। বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ মাথায় নিতে হয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। কখনো কখনো কোনো অভাব পূরণ হয়, কখনো কোনো অপরাধের তদন্ত হয় কিংবা অপরাধীর শাস্তি হয়। কিন্তু অনেক সময়েই আমাদের বিবেককে টলানো যায় না। সন্ত্রাসের সংবাদ পড়ে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, আত্মীয় স্বজনের বাইরে, অন্যের কাছে নিহত ব্যক্তি একটা সংখ্যার বেশি বলে আর পরিগণিত হন না। এই যে পাবলিক পরীক্ষায় নকলের যে হিড়িক, পরীক্ষার সময় তার সচিত্র বিচরণ প্রকাশ পায় সংবাদপত্রে। তারপর প্রতিরোধ হওয়াতো দূরের কথা, নকলে বাধাদানকারী লাঞ্ছিত হন, সাংবাদিক হুমকির সামনে পড়েন। যে সমাজে বাপমা, ভাইবোন মিলে পরীক্ষার্থীকে নকল করতে উৎসাহ দেয়, নকল সরবরাহ করে, সে সমাজে বিবেক বলে কিছু থাকার কথা নয়। কেউতো একদিনে নষ্ট হয় না। সে যখন অজ্ঞাত সূত্র থেকে অর্থ বা সম্পদ নিয়ে আসে বাড়িতে, অস্ত্র রাখে, বোমা বানায়, তখন বাপমা অভিভাবক কিছু বলেন না, পাড়াপ্রতিবেশী কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পান না। তারপর যখন একদিন সে অপরাধ জগতে কেউকেটা হয়ে পড়ে, তখন কারো টনক নড়ে, কেউ উল্লসিত হয়। সন্ত্রাসীরা যেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, সেখানে নিরন্তর সন্ত্রাস যে চলবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে সমাজে এমন ঘটতে থাকে, সে সমাজে শুধু সাংবাদিকেরাই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবেন, এমন আশা দুরাশা মাত্র। তবু তারা যে অনেকেই তা করছেন, তা অন্ধকারে দীপশিখার মত। ভ্রষ্ট ও নষ্ট সময়ে বিবেক বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। আমাদের মৃতপ্রায় সম্মিলিত বিবেককে জাগিয়ে রাখার যে প্রয়াস এখনো সাংবাদিকেরা নিচ্ছেন, তার পরিণতি কী হয়, তা বলা কঠিন। কিন্তু ইতিহাসে সে প্রয়াসের কথা নিশ্চয় লেখা থাকবে।’ [সাংবাদিক/আনিসুজ্জামান, সংবাদ ১৪ জুন ২০১২]

সাংবাদিক সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, অন্যায়অবিচারশোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধাচরণ, দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষাবলম্বন এবং নৈতিক আদর্শে অবিচল এমন মানুষ বা পেশাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। কেননা, আমরা জানি সমাজে সুশাসনের সমস্ত ধারণাই শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম দ্বারা পরিচালিত হয়।

আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, মানুষে মানুষে, গোত্রে গোত্রে, বর্ণে বর্ণে, ধর্মে ধর্মে বিভেদকারীর সংখ্যাও কম নয়। বিভেদ কখনো রাজনীতিআশ্রিত, কখনো বা সম্প্রদায়গত, আবার কখনো ভূখণ্ডগত। সমাজের এ বিভেদকে সংকুচিত করা কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র বড় ভূমিকা পালন করে। সত্য ও নির্ভীক সাংবাদিকতা একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে, অন্যদিকে ইতিবাচক সমাজ প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করে। সৎ সাংবাদিকতা সবসময় সত্যেরই আরাধনা করে। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকে আঁকড়ে ধরে সংবাদপত্র এগিয়ে যায়। এর একটু এদিক ওদিকে হলে অগ্রগতি ব্যাহত হয়, উন্নয়ন হয় বাধাগ্রস্ত। গণতন্ত্র বিকাশের পূর্বশর্ত হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বহুমাত্রিকতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এ ব্যাপারে সরকারের দায়বদ্ধতা দরকার, যাতে করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বহুমাত্রিকতাকে মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা’ বলতে যা বোঝানো হয়, সম্ভবত তার চর্চায় কিছুটা ঘুণ ধরেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সাংবাদিকের স্বেচ্ছাচারও। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৎ সাংবাদিকতার ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, ম্লান হচ্ছে তার মহিমা। ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের পক্ষে যথেচ্ছাচার অকল্পনীয়’ বলেছেন এম আই চৌধুরী। তাই স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা করে সাংবাদিকদের হাঁটতে হয়, চলতে হয় নির্ধারিত দায়দায়িত্ব মেনেই। স্বাধীনতা ও দায়দায়িত্বের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যএ কথা সবসময়েই যেন আমরা ভুলে না যাই।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো, বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের ৫৪ বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে মাইজভাণ্ডারী দর্শন নিয়ে সেমিনার