গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নাম পরিবর্তন করে জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ করার সুপারিশ

সংবিধান সংশোধনে আরও যেসব সুপারিশ করা হয়েছে । রাস্ট্র পরিচালনার ৩ মূলনীতি বাদ, গণতন্ত্র বহাল রেখে নতুন ৪ মূলনীতি । সংসদের মেয়াদ ৪ বছর, এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় । নূন্যতম ১০% আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে । সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নূন্যতম বয়স হবে ২১ বছর

আজাদী ডেস্ক | বৃহস্পতিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’ দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে। এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে। এ ছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’ এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬() ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ “বাংলাদেশি” বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে। ৩ মূলনীতি বাদ, নতুন ৪ মূলনীতির সুপারিশ : বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হলোজাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মূলনীতিগুলোর মধ্যে শুধু গণতন্ত্র রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির মধ্যে। সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলোসাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে। আর তিন মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, , ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ হবে চার বছর : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর এবং তিনি দুইবারের বেশি এই আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইলেকটোরাল কলেজ বা ভোটারদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য প্রতি একটি করে ভোট; প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট [উদাহরণ: ৬৪টি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ থাকলে ৬৪টি ভোট]; প্রতিটি ‘সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোটের মাধ্যমে এটি গঠিত হবে। সুপারিশে রাষ্ট্রপতি অভিশংসনের বিষয়েও বলা হয়েছেরাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে জানান, কমিশন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর সুপারিশ করেছে।

কমিশনের সুপারিশে যা যা আছে : প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের একটি সারসংক্ষেপ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৭টি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বিষয়গুলো হচ্ছে১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ এবং মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ। সেইসঙ্গে, সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনার ভাষ্যকে পরিবর্তন করে পুনঃপ্রতিস্থাপন করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রস্তাবনার সেই ভাষ্যে একই সাথে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলনের আদর্শকে সামনে রেখে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি, যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে; আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহির চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে, সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে।

কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। বিদ্যমান সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকারসমূহ সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ নামে একটি একক সনদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে। পাশাপাশি, কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করছে, যেখানে একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট) থাকবে এবং। এখানে উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। সেখানে, উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ (একশো পাঁচ) জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে, যার মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। বলা হয়েছে, একজন সংসদ সদস্য একই সাথে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রধানএই তিনটির যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। এর পাশাপাশি, অর্থবিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে এবং আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।

তরুণদেরকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করারা ভাবনা থেকে কমিশন আরও সুপারিশ করেছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০% আসনে তরুণতরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে এবং সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স হবে ২১ বছর। সংসদে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত এক জনসহ ২ (দুই) জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, এবং সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুইতৃতীযাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন ও পরবর্তীতে প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে, গণভোটে উপস্থাপন করার সুপারিশ ও করেছে কমিশন।

রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং আইনসভার মেয়াদ শেষ হবার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেয়া পর্যন্ত, সর্বোচ্চ ৯০ (নব্বই) দিন মেয়াদের একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করেছে।

সুপারিশে জনদুর্ভোগ নিরসনে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সকল বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করছে। এতে বলা হয়েছে, তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। পাশাপাশি, কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানের সুপারিশ করছে।

এছাড়াও সংবিধানে কিছু নতুন অধিকার যেমন খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, ইন্টারনেট প্রাপ্তি, তথ্য প্রাপ্তি, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ, গোপনীয়তা রক্ষা, ভোক্তা সুরক্ষা, শিশু উন্নয়ন, বিজ্ঞান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াটা জরুরি : প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধইনজুরিতে বিপিএল শেষ রাকিম কর্নওয়ালের