সড়কে দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় মানুষের অঙ্গহানি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গণপরিবহনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের দেশের গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলাও নতুন নয়; সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে এ ইস্যুতে অনেক কথা হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পরিবহন খাতে চলমান বিশৃঙ্খলার মূল কারণ এ খাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের অসহায়ত্ব এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্ভরশীলতা। যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট প্রদানের এখতিয়ার শুধু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবহন নেতাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী রুট পারমিট দেওয়া হয়ে থাকে। যানবাহনের মালিকানা বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক যাওয়ায় যখন-তখন সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য। এখন কোন গাড়ির আগে কোনটি যাবে, এ নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। রাস্তা দখল করে যাত্রী ওঠানামা করে। এর পেছনে রাজনৈতিক, পেশিশক্তি অর্থ লেনদেনের বিষয়ও আছে বলে জানা যায়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘গণপরিবহনে পুরনো বিশৃঙ্খলা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নগরীতে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় এখনও বিরাজ করছে সেই পুরনো বিশৃঙ্খলা। নির্ধারিত স্থানে বাস থামে না, উপরন্তু মাঝ সড়কেই যাত্রীরা ওঠানামা করেন। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীতে গণপরিবহনের এমন বিশৃঙ্খলার জন্য বাস চালক ও হেলপারদের পাশাপাশি দায় রয়েছে যাত্রীদেরও। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, উপসর্গ ভিত্তিক কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, যদি সেখানে বিজ্ঞানসম্মত কোনো নির্দেশিত পথ না থাকে। আমরা যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে চাই উপসর্গ দিয়ে। যে কারণে কোনো নির্দেশনা কাজে আসছে না। এজন্য প্রয়োজন একটি মডেল করিডোর। একটি করিডোরে একজন মালিকের বাস চললে সেখানে কোনো পুলিশ লাগবে না। এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর অধিকাংশ স্থানেই ফুটপাত ঘেঁষে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়কের মাঝপথ থেকে যাত্রীদের ওঠানামা করানো হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার এসব দৃশ্য চোখে পড়ে। আন্দরকিল্লার মোড়, কাজির দেউড়ি মোড়, জিইসির মোড়, ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, প্রবর্তক মোড়, নিউমার্কেট মোড়সহ বিভিন্ন সিগন্যাল পয়েন্টে ছিল না শৃঙ্খলা। সড়কগুলোতে দৌড়ে গিয়ে সড়কের মাঝখানে যাত্রীদের চলন্ত গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে।
গণপরিবহনের ভাড়া নিয়েও নৈরাজ্য চলছে। কোন নিয়ম নীতিমালা মানছে না পরিবহন মালিকরা। কোন পরিবহন কত টাকা ভাড়া আদায় করবে, কতদিন পর পর ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে। এই বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই সরকারের। এছাড়া ভাড়া নির্ধারণের যে কমিটি রয়েছে সেখানে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের প্রাধান্য বেশি। তাই গণপরিবহনের ভাড়া নিয়ে কোন সুষ্ঠু সমাধান কখনো হয় নি।
যত্রতত্র বাস থামলে বা চালকেরা আইন ভাঙলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়। ট্রাফিক আইন ভঙ্গে উভয় পক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অনানুষ্ঠানিক সমাধা করাকে শ্রেয়তর মনে করে, কারণ তা দ্রুত ও সাশ্রয়ী। আইন প্রয়োগকারীদের মতে, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির মান ও চালনায় অনিয়মের মামলা দিতে গেলে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। গণপরিবহনের ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য যা যা করা দরকার: রুট পারমিটের প্রক্রিয়া সংস্কার করা, দক্ষ ও পেশাদার চালক তৈরির পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা; টিকিট কাউন্টার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও অনলাইন টিকিটের ব্যবস্থা প্রবর্তন; বিআরটিএকে শক্তিশালী করে গাড়ির মান যাচাই এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহির ব্যবস্থা করা; ভালো কোম্পানিকে এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা এবং ট্রাফিক আইন মানতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো। আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপের ফলে নগরীর রাস্তায় শৃঙ্খলা আসবে এবং জনচলাচল নিরাপদ হবে।
সড়ক-মহাসড়কে বেঘোরে মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের কাছে সারাজীবনের জন্য গভীর ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে জারি রয়েছে, বেরও হয়েছে অনেক কিছু। তবু বছর বছর দুর্ঘটনা নতুনরূপে হাজির হচ্ছে, এটা কাম্য নয়। এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের দ্রুত সক্রিয়তা জরুরি।