সমাজ এলো, মানুষগুলো ভাগ হলো, রাজা আর প্রজায়, শাসক আর শাসিতে। রাজা রাজ্য চালায়, রাজার ইচ্ছাই আইন, রাজা হোন স্বৈরাচারী। প্রজারা কখনো দাস, কখনো ভূমিদাস। অধিকার আর সুযোগ সব রাজার। প্রজার কোন অধিকার নেই। সমাজতো এমনিই চললো।
কিছু মানুষ ছিলো ব্যবসায়ী। কিছু মানুষ বুদ্ধিমান, বিজ্ঞানী। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে, পররাজ্য লুণ্ঠন করে, সমুদ্রপথে জাহাজে ডাকাতি করে বিশাল সম্পদের মালিক বনে গেলেন। ওঁরা লুণ্ঠিত অর্থ দিয়ে, মেশিন আর কলকারখানা কিনতে শুরু করেন। কিন্তু কারখানায় কাজ করবে কে? মানুষ–জনতো ভূমিদাস হয়ে আছে! ওদের ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্ত করে, স্বাধীন মজুরে পরিণত না করা গেলে কারখানা শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে কে? তো এমন হলে কারখানা চালানো যাবে না। তো! তো, ভূমিদাসদের ভূমির নিগড় থেকে মুক্ত করতে হবে। রাজা নয়, প্রজারাই হবেন রাজ্যের বা রাষ্ট্রের মালিক। বললেন বুদ্ধিমান চিন্তাবিদরা। বললেন, প্রজারা হচ্ছেন সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। ওদের ইচ্ছাতেই রাজ্য/রাষ্ট্র চলবে। ফলে আন্দোলন হলো। রাজার ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা হলো। কোথাও হলো গিলোটিনে শিরশ্ছেদ। রাজতন্ত্র বদলে এই নয়া ব্যবস্থাকে নাম দেয়া হলো গণতন্ত্র। যদি রাজ্যের প্রধান রাজা না হয় তো বলা হলো প্রেসিডেন্ট। রাজতন্ত্রের জায়গায় এলো প্রজাতন্ত্র অথবা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র।
প্রজাতন্ত্র এলো, তো প্রজারা কি শাসক হলো? না। কারণ প্রজাদের সবাই শাসক হতে পারেন না। তো। তো পার্লামেন্ট করা হলো। প্রজারা নির্বাচিত করবে, তাঁদের ভেতরের মানুষদের। ওঁরা আইন তৈরি করবে, সরকার গঠন করবে। বিচারপতি করবে নিয়োগ। এমনকি প্রেসিডেন্টও। নির্বাচিতরা আর প্রজা নন। ওঁরা শাসক। ওঁরা যে কারণে রাজতন্ত্রের ভূমিদাস, প্রজাতন্ত্রের শ্রমিক বা স্বাধীন মজুরে পরিণত হলো, সেটাই হলো, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণ। যে ব্যবসায়ী, ব্যবসার স্বাধীন পরিবেশের জন্য আন্দোলন করলো, স্লোগান দিলো, Laissez Faire Economy মুক্ত বাজার অর্থনীতির, সে বিষয়টা ধারণায় না নিয়ে গণতন্ত্র হয়না। শুধুমাত্র প্রজাকে শাসক বানানোর জন্য প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্র আসেনি। অর্থনীতির রূপান্তর ছাড়া গণতন্ত্র পোক্ত হয়না। পোক্ত হয় না শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার সমুন্নত করা ছাড়া।
গণতন্ত্র কি শুধুই প্রতিষ্ঠান না সামাজিক ব্যবস্থা? সমাজবিজ্ঞানীদের মাঝে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ধরুন পরিবারের কথা। পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান, কারণ এর সমাজ নির্দেশিত প্রতিষ্ঠিত কাজ সম্পন্ন করে। পরিবার না থাকলে আমরা কেউই সামাজিক হতাম না। প্রজাতন্ত্রের সমস্ত প্রজাই কোন না কোন পরিবারের সদস্য। পরিবারের সদস্যরা পরিবারের মূল্যবোধ মেনে চলে আর এই মেনে চলায় পরিবার সংঘবদ্ধ থাকে পরিবারের একাজ সমাজের গাঁথুনির উপায় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠিত কার্যাবলী আছে বলে এও প্রতিষ্ঠান। এধানের হাজারো প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। সুতরাং সমাজের হাজারো প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত না হলে, প্রজাতন্ত্রে প্রজাদের শাসন থাকে কী করে? প্রজাদের শাসন থাকলেও, শাসকবৃন্দ বিচ্ছিন্ন হয়, প্রজাতন্ত্রের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে। যাঁরা স্বৈরশাসক তাঁরা কখনোই প্রজাতন্ত্রের হাজারো প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর রাখে না। প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হলে, রাষ্ট্র ও অঙ্গবিভাগসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। স্বৈরাচার পোক্ত হতে থাকে। যতই সময় যায়, সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হতে থাকে।
তবে সব কর্তৃত্ববাদ বা একনায়কতন্ত্র এক নয়। Totalitarjanismবা সর্বাত্মকবাদ, কোন আদর্শ দ্বারা সমগ্র জীবন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে। নাজীবাদ, ফ্যাসীবাদ পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তর ও সারা পৃথিবীর মানচিত্রকে পুনঃ বিভাজনের জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণা নিয়ে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে। কোন ব্যক্তি যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও নিজের ক্ষমতাকে সংহত করবার জন্য সচেষ্ট থাকে, তা ব্যক্তির স্বৈরাচার হয়। এতে ব্যক্তি, হেন অনিয়ম নেই যা করেন না। দুর্নীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সবগুলোকে ধ্বংস করে দেন। ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করা বলতে যা বোঝায় তা আসলে এমন পরিবেশ তৈরি করে যেখানে, গুম ও হামলা, মামলার মাধ্যমে এক ভয়ের আবহ তৈরি করা হয় ।বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়,শোষণ আর বঞ্চনা চরম পর্যায়ে যায়। সমাজ হয় মাৎস্যন্যায়। এমন স্বৈরাচার জনগণের মতামতকে মোটেই গ্রাহ্য করে না। স্বৈরাচার ভয়ের আবহ যেমন তৈরি করে, ঠিক একেবারে সমাজের গ্রাসরুট লেভেলে গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি চর্চা করে।
জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি, সমাজের আইন–কানুন, রীতি–নীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাসের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া থাকে সব মানুষেরই । আর এই প্রক্রিয়াই হলো সামাজিকীকরণ। এই প্রক্রিয়া মানুষকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য করে। কেউ কতটুক সভ্য ও গণতান্ত্রিক আচরণ করবে তা শৈশব থেকে বার্ধক্যের কাল পর্যন্ত সামাজিকীকরণের ফলে হয়ে থাকে। এখানে এই প্রক্রিয়ায় ঘাটতি থাকলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবেনা।
এই ধরুন, স্কুলের ছাত্রদের এসেম্বলিতে জড়ো হওয়া। এইটি সংহতি ও সংঘবদ্ধ হওয়ার সামাজিকীকরণ। এমন হাজারো প্রক্রিয়া মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের উপায়। মানুষের পরিণত বয়সেও এমন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সামাজিকীকরণ হয়ে থাকে। আমাদের স্কুল–কলেজ এর গভর্নিং বডিগুলো কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়? ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স এর বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স? চর দখলের মতো, ব্যাংকের বোর্ড সদস্যপদ দখলও দেখেছি আমরা। সমাজের গ্রাসরুটে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সমিতি রয়েছে সেগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাড়িত না হলে, উপরি–স্তরে গণতন্ত্র চর্চা হবে? আর এই অর্থে গণতন্ত্র সামাজিক কাঠামোও নির্মাণ করে। সেই দিকটা দেখি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের উন্নত অর্থনীতির দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয় না। সামরিক ক্যু বা অভ্যুত্থান উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশসমূহের ঘটনা। এসব দেশে গণতন্ত্র সামাজিক কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্যক্তি স্বৈরাচরী হয়ে উঠবার প্রবণতা থাকলেও, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক কাঠামোর কারণে তা হয়ে ওঠে না।
তাই সমাজ সংস্কার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গণতন্ত্রের ভিত্তিটা তৈরি করে। মনে রাখলে ভালো যে, বাজার অর্থনীতির ধারণা বাস্তবায়নের তাগিদ না থাকলে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণতন্ত্রের ধারণাই আমরা পেতাম না।
আমরা সচরাচর যেসব শব্দের প্রয়োগের জন্য খুব উচ্চকণ্ঠ, যেমন, মানবাধিকার, ভোক্তাবাদ, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি এর সবগুলোই শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই অর্জন সম্ভব। সুতরাং সমাজের ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। আর এই মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠিত কার্যাবলী কাজ করতে শুরু করলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।
আমরা বলি ইউরোপে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পুঁজিবাদ এলো, আসলে এলো গণতন্ত্র। রাষ্ট্রের পরিচিতি হলো প্রজাতন্ত্র বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র যা আসলে গণতন্ত্রকেই বোঝাতো। এইটি বলার উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কাঠামোর নির্মাণে গুরুত্ব বোঝানো। আধুনিক গণতন্ত্রের আগে কখনোই দল ব্যবস্থা ছিলো না। দলগুলোও অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা না করলে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পেলে তখন আর গণতান্ত্রিক আচরণ করে না। কোন গবেষণা ছাড়াই, বাংলাদেশের ইতিহাসে নজর দিলে আমাদের দল ব্যবস্থায়, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অভাব খুব ভালোভাবেই দেখা যায়।
শুধু ইঞ্জিন দিয়ে গাড়ী চলেনা। দরকার ড্রাইভার। এতো হলো হিউম্যান ওয়্যার। কম্পিউটার এর কানেক্টেড ডিভাইস চালাতে লাগে ড্রাইভার সফটওয়্যার। গণতন্ত্র ও এর মূল্যবোধ সমাজের সব প্রতিষ্ঠান কার্যকর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠার জন্য দরকার এমন হিউম্যান ওয়্যার, যাঁরা তাঁদের সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করবার সুযোগ পাবেন।
দেশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে চলে কিনা তা জানবার উপায় হলো, শিক্ষাঙ্গনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয় কিনা, ছাত্র সংসদ গুলোর নির্বাচন হয় কিনা, বাজারের শক্তি সচল আছে কিনা, অর্থ হলো, ভোক্তা ভোগের সামগ্রী ক্রয় করতে স্বাধীন কিনা, বিক্রেতা ইচ্ছা মাফিক নয়, বাজারের শক্তির দ্বারা পণ্য মূল্য নির্ধারণ করছেন কিনা ইত্যাদি। সর্বোপরি আইনের শাসন চালু আছে কিনা? একজন রাজনীতিবিদের কাছে নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের সূচক বটে। কিন্তু খেটেখাওয়া মানুষের কাছে? তাঁর মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র কাজ করে কিনা? অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা সেবায় রাষ্ট্র, সরকার ব্যাপৃত কিনা? সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয় কেমন করে? চিকিৎসা ও আইনী সেবায় নাগরিকের সেবা পাওয়ার অধিকার নেই, কিভাবে এমন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলবেন? গণতন্ত্র, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সম্পর্ককে যখনই সুশৃঙ্খল মাত্রায় নিয়ে আসবে, তখনই সমাজের পরিপূর্ণতা আসবে।
লেখক: উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম।











