মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম শর্ত গণতন্ত্র। ভোট মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে ভোটাধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ভোট অধিকার নিশ্চিত না হলে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকে না। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে না পারলে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। এজন্য গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত মানুষের ভোটাধিকার। সহজ কথায় ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’। এটা খুব জনপ্রিয় শ্লোগান হলেও এর মাঝে ভোটের মমার্থ লুকিয়ে আছে। ভোটের সব কেন্দ্রে এ শ্লোগান বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়। ভোট শুধু মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নয় মৌলিক অধিকারও। সাধারণত কারো মৌলিক অধিকার খর্ব করা যায় না। মৌলিক অধিকারকে বাধাগ্রস্থ করা যায় না। মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানব অধিকার লঙ্ঘন করার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয় না। ভোটের মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার ম্যান্ডেট দেওয়া হয়। মানুষের মৌলিক অধিকার–ভোটাধিকার ক্ষুন্ন করা বা কেড়ে নেওয়ার কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয় না। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। কেউ কেউ ভাতের অধিকারের কথা বলে। নিশ্চয় ভাতের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। শুধু ভাতের অধিকার নয় গণতান্ত্রিক ধারায় মানুষের ভোটের অধিকারও নিশ্চিত করতে হয়।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন বলতে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে তারা সরকার গঠন করে শাসন ভার গ্রহণ করবে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। সরকার পরিবর্তন হলেও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। দল মত নির্বিশেষে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষিত হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। ভিন্ন মতের প্রতি পারস্পরিক সহিষ্ণুতা থাকবে। সহনশীলতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হয়। পারস্পরিক সহনশীলতা না থাকলে গণতন্ত্র কোনো দিন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে না। যে কোনো সময় গণতন্ত্র ব্যাহত হতে পারে।
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের সঙ্গে এবার অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার। অংশগ্রহণমূলক বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। অংশগ্রহণ বলতে সকলের অংশ গ্রহণ বুঝায়। সাধারণ অর্থে সব দলের অংশ গ্রহণ। বিশেষ করে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ গ্রহণ। কোন নির্বাচনে দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ গ্রহণ করে না। বড়, ছোট, মাঝারি নানা ধরনের দল রয়েছে। নিবন্ধনকৃত সব দল সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দেয় না। অন্য দলের কোনো না কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে। জোটের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার চেষ্টা করে। এতে দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হয়ে যায়। নির্বাচন নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলে।
এখন বড় কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে কিংবা ঐ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছোট ছোট দলগুলো নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন অংশগ্রহণ মূলক হবে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। বড় বড় রাজনৈতিক দলের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার রয়েছে। বড় দলের কোনো একটি নির্বাচন অংশগ্রহণ না করলে তাদের ভোটারেরা নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে কিনা সে প্রশ্ন এসে যায়। এসব দলের ভোটার স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার কথা নয়। যেহেতু নির্বাচনে তাদের দলের কোনো প্রার্থী নেই তারা ভোট দেবে কাকে? বিরোধী পক্ষের প্রার্থীরাতো ভোট দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো প্রার্থী বেছে নিতে পারে। যদি সেরকম কোনো প্রার্থী থাকে। অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন বলতে অনেকে জনগণের অংশ গ্রহণের কথা বলে থাকেন। অর্থাৎ ভোটারদের ভোটে অংশগ্রহণ। শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি ভোটার ভোট প্রদান করলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। প্রশ্ন হলো এ পঞ্চাশ বা ষাট ভাগ ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট দিতে পারছে কি না? এ ব্যাপারে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেকে বলে কেন্দ্রে যাওয়ার আগে ভোট দিয়ে ফেলেছে। কেউ বলে আগের দিন ভোট হয়ে গিয়েছে। ভোট দেওয়ার জন্য এখন আর ভোট কেন্দ্রে যেতে হয় না। ভোট এমনিতেই হয়ে যায়।
এতে করে মানুষের আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ থাকে না। উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে আগে যে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করতো এখন সেটা আর দেখা যায় না। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে না পারলে সেখানে ভোটাধিকার প্রয়োগ হয় না। তখন জনগণের অংশ গ্রহণ মূলক নির্বাচন বলা যায় না। কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সেদলের কর্মী সমর্থক ভোটারেরা ভোট প্রদান না করতে পারে। কিন্তু যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রার্থী দেয় তাদের ভোটাররা যেন নিজের ভোট নিজে দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে বলা যাবে নির্বাচন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণমূলক হয়েছে।
বিগত সময়ে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে জনমনে যে শঙ্কা তৈরী হয়েছে তা দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষকে ভোটের আস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে ভোটারেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভোট প্রদান করে শুধু প্রার্থীকে নির্বাচিত করে না, তাদের মতামত নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। দেশের মানুষের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হলে বিশ্ববাসীর কাছেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হবে।
অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সব দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। সমঝোতা বা আলাপ আলোচনার কোনো পরিবেশ তৈরী হয়নি এখনো। এদিকে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। সরকারও সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন করার জন্য বদ্ধপরিকর। বিরোধী পক্ষ এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। সরকার পতনের একদফা দাবী নিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে। জেলা উপজেলায় পদযাত্রা ও তারুণ্যের সমাবেশ নাম দিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে চলছে। কোনো কোনো সময় সমাবেশের উত্তেজনা সহিংসতায় রূপ নেয়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। জনগণের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচির পাশাপাশি শাসক দলের কর্মসূচিও চলতে থাকে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে জনজীবনের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের এসব কর্মসূচিকে কখনো সমর্থন করে না।
কোনো পক্ষ নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচন হয়ে যায়। কিন্তু নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে কিংবা নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইলে সংঘাত অনিবার্য। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কোন কোন জায়গায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। হতাহতের ঘটনাও ঘটে। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। ভয়–ভীতির সঞ্চার হয়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয় না। সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা থাকলে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পায়। কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি আশানুরূপ হয় না। নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছে না। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেলে কোনো কোনো ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভোটারের অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব হয় না।
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম এ বাংলাদেশে বায়ান্ন বছরেও শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গড়ে উঠেনি। যার মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। যেখানে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। স্বাধীনতার এত বছর পর মানুষের ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করার কথা নয়। অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বাইরের চাপ এদেশের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করেছে তার সুদূর প্রসারী প্রভাব শুধু নির্বাচন বা রাজনীতিতে নয় অর্থনীতিতেও নানাভাবে পড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবে। এর বিরূপ প্রভাব থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে না। উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা তা ব্যহত হবে। বহিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকবে না। অস্তিতিশীলতার দিকে ধাবিত হবে। সংঘাত ও সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। এধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়। সবাই চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন। যে নির্বাচনে সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে। এর জন্য নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে আলাপ–আলোচনা বা সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সমস্যা ও সংকট উত্তরণে আলাপ–আলোচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আশা করি দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিকদের মধ্যে এ শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।