সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ গণতন্ত্র চায়। ব্যবসায়ীরা গণতন্ত্র চায়। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে। মিছিল মিটিং করে। রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দেয়। প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে। সভা সমাবেশ করে। অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে। লাঠি চার্জ টিয়ারগ্যাস উপেক্ষা করে। জলকামানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রবার বুলেটকে আলিঙ্গন করে। জেল জুলুম আর নিপিড়নের শিকার হয়। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। তারপরও জনগণ গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে। বুকের রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্র চায়। ছাত্র–জনতা কৃষক শ্রমিক সবাই গণতন্ত্র চায়। ধর্ম বর্ণ দল মত নির্বিশেষে সকল মানুষ গণতন্ত্র চায়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চায়।
গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের। বহু বছরের, বহু যুগের। প্রায় এক শতাব্দীর। যুগে যুগে মানুষ অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছে। সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। জোর জবরদস্তির বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়েছে। সামন্ত প্রথা জমিদারী প্রথার অবসান চেয়েছে। প্রজা প্রথার বিলুপ্তি চেয়েছে। নতুন শাসন ব্যবস্থা চেয়েছে। যে শাসন ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকে। ন্যয্যতার ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছে। যেখানে নির্যাতন নিপিড়ন নয়, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মানুষ তার অধিকারের কথা বলতে পারবে।
সমাজের নানা অসঙ্গতি বহু কাল থেকে। শুধু অসঙ্গতি নয় বৈষম্যও কাল অবধি বিরাজমান। সাংস্কৃতিক ধারার মতো অনধিকাল থেকে প্রবাহমান। মানুষ এসবের মাঝে সমাজে বসবাস করে। সমাজে থাকতে হলে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। ইচ্ছা না হলেও মেনে নিতে হয়। সমাজ মানুষের কল্যাণ চায়। এ ধারণা পোষণ করে সমাজে থাকতে হয়। আবার মানুষ সমাজ ছাড়া থাকতে পারে না। মানুষকে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। এজন্য সমাজের রীতি নীতির বাইরে যাওয়া যায় না। নিয়ম কানুন মেনে সমাজে থাকতে হয়। তবে এসব নিয়ম নীতি সবার জন্য একই রকম নয়, সমান নয়। মানুষভেদে এসবের তারতম্য ঘটে। এতে করে মানুষের মাঝে সমাজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
মানুষ সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে চায়। বৈষম্য কমাতে চায়। মানুষ মানুষে ভেদাভেদ কমাতে চায়। গণতান্ত্রিক সমাজ চায়। মানবিক সমাজ চায়। কল্যাণমুখী সমাজ চায়। গণমুখী সমাজ চায়। যে সমাজ সাধারণ মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা করবে। সাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। অধিকারকে সমুন্নত রাখবে। যে সমাজে সব মানুষের জন্য একই ধরনের নিয়ম কানুন চালু থাকবে। যে সমাজ বিশেষ কোন গোষ্ঠীর নয়, সম্প্রদায়ের নয়, দলের নয়। যে সমাজ পেশীশক্তির কাছে মাথা নত করে না। অন্যায়ের কাছে হার মানে না। অবিচারকে প্রশ্রয় দেয় না। মানুষ এরকম একটি সমাজ চায়। গণতান্ত্রিক সমাজ।
আসলে মানুষ গণতান্ত্রিক সরকার চায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। গণতান্ত্রিক দেশ চায়। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান যেন গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হয় এ ধরনের ব্যবস্থা চায়। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক ধারায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা গেলে দেশ একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। এতে করে গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ধারা সুদৃঢ় হয়। তবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া অন্য কোন সরকার গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনা করতে পারে একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকার। সরকার গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থি হলে প্রতিষ্ঠানগুলোও অগণতান্ত্রিক ধারায় ধাবিত হয়।
গণতান্ত্রিক সরকার ইচ্ছা করলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। তবে দেশকে গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে হলে জনগণের অংশ গ্রহণ প্রয়োজন। দেশের গণতন্ত্রের সাথে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক। এজন্য দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যেতে হলে জনগণকেও সাথে নিতে হয়। অর্থাৎ জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হয়। এজন্য সকল গণতান্ত্রিক সরকার দেশকে গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে পারে না। গণতন্ত্রের প্রতি সরকারের অবিচল আস্থা ও দৃঢ়তা না থাকলে তা কখনো সম্ভব হয় না। জনগন দ্বারা নির্বাচিত সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম হয় না। যে কোন সমাজ গড়ে ওঠে সময়ের ব্যবধানে। গণতান্ত্রিক সমাজও গড়ে তুলতে হয়। বিনির্মাণ করতে হয়। বছরের পর বছর চেষ্টা করে গণতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরী করতে হয়। গণতান্ত্রিক আচার আচরণ মানুষের মাঝে তৈরি না হলে সমাজে কখনো এর প্রতিফলন ঘটে না। এজন্য গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। দীর্ঘ দিন ধরে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে পারলে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায়। তবে গণতান্ত্রিক সরকার বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে কখনো গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম করা যায় না।
গণতন্ত্র চর্চার ব্যাপার। অনুশীলনের ব্যাপার। সহনশীলতার ব্যাপার। পরম সহিষ্ণুতার ব্যাপার। ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার ব্যাপার। পারস্পরিক সহঅবস্থান ও সহমত পোষন করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রকাশ। কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, প্রতিহিংসা নয়। কাউকে বাদ দিয়ে নয়। সবাইকে সাথে নিয়ে চলার নাম গণতন্ত্র। দল মত নির্বিশেষে সকলে একসাথে পথ চলার নাম গণতন্ত্র। করো মতকে উপেক্ষা করে নয়। সবার মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে চলার নাম গণতন্ত্র। হঠাৎ করে গণতন্ত্র্ত্র আসে না। গণতন্ত্রকে ধারণ করতে হয়। অনেক বিষয়ের উপর গণতন্ত্র নির্ভর করে। তার মধ্য নির্বাচন অন্যতম।
গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে। যে নির্বাচনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারে। নির্বিঘ্নে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। এজন্য নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হয়। এরকম একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে। মানুষের দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ স্বপ্ন শুধু গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। গণতান্ত্রিক দেশের। গণতান্ত্রিক সমাজ বির্নিমাণের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী