
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে আজ এক গভীর বিষণ্নতার ছায়া। বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে দেশ অভিভাবকহীনতার মুখে দাঁড়িয়েছে। তাঁর এই মহাপ্রয়াণ কেবল একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষতি নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য এক অপূরণীয় রিক্ততা। মহাপ্রাণ দার্শনিক ও কবি খলিল জিবরান মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করতে হলে জীবনের গহীনে প্রবেশ করতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ছিল ঠিক সেই প্রবহমান নদীর মতো, যা চড়াই–উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে মহাকালের সাগরে মিশে গেছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য আলোকবর্তিকা। তিনি কেবল সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না, বরং নিজের সাহস ও অনমনীয়তা দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এক অটল গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব। আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক বিবর্তন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি জাতির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি কীভাবে নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন।
১৯৮০–এর দশকের সেই অন্ধকার সময়ে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের নিগড়ে বন্দী ছিল, তখন এক সাধারণ গৃহবধূর নিভৃত জীবন ছেড়ে তিনি দেশের মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮১ সালে স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক ও আকস্মিক মৃত্যুর পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যখন এক চরম নেতৃত্ব সংকটে পতিত, তখন তিনি অসীম সাহসে দলের হাল ধরেন। মুহূর্তেই তিনি নিজেকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক কঠিন সংগ্রামে সমর্পণ করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এই প্রারম্ভিক পর্বেই তিনি ‘আপোসহীন নেত্রী‘ হিসেবে জনমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যখন অনেক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব কৌশলগত আপোসের পথে হেঁটেছেন, তখন বেগম জিয়া তাঁর অটল ব্যক্তিত্বের কারণে কোনো প্রকার সমঝোতা বা অনৈতিক চুক্তিতে যাননি। তাঁর এই কঠোর অবস্থান দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে এক দুর্জয় প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। দীর্ঘ আট বছর ধরে চলা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি সাত–দলীয় জোটের আপোসহীন নেতৃত্ব প্রদান করেন। রাজপথের প্রতিটি মিছিলে তাঁর উপস্থিতি কর্মীদের মনোবলকে তুঙ্গে নিয়ে যেত। তাঁর এই হার না মানা মনোভাবের ফলশ্রুতিতেই ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল, যা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূর্যকে ফিরিয়ে আনে। তাঁর এই সংগ্রাম কেবল ক্ষমতার জন্য ছিল না, বরং ছিল জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার এক পবিত্র অঙ্গীকার।
১৯৯০–এর গণবিপ্লবের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম মেয়াদের সবচেয়ে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন। রাষ্ট্রপতি–শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাফল্য। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাত থেকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের কাছে ন্যস্ত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় এক মৌলিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন। বেগম খালেদা জিয়ার এই সাহসী সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার অকাট্য পরিচায়ক। তাঁর শাসনামলে সংসদ হয়ে উঠেছিল প্রচণ্ড প্রাণবন্ত, যেখানে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের সক্রিয় আলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সংসদীয় চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল।
শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং উপবৃত্তি প্রবর্তন নারী শিক্ষার প্রসারে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর ‘ডাল–ভাত‘ কর্মসূচি এবং তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়নের দর্শনে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ প্রশস্ত হয়, যা দেশকে আধুনিকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করেছিলেন এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করেছিল।
খলিল জিবরান বলতেন, আশা ও আকাঙ্ক্ষার গভীরে অসীম জ্ঞান লুকানো থাকে। বেগম জিয়া আজীবন সেই অসীমের স্বপ্ন লালন করেছেন একটি স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন। ১৯৯৬ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তিনি সংবিধানে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেন। নিজের অর্জিত ক্ষমতাকে জনগণের ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, যা তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আজীবন দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে। রাজনীতিতে তাঁর এই বহুমুখী অবদান, তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন এবং সংসদে দুইবার বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন তাঁকে দেশের এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কিন্তু গত দেড় দশকে তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল নিষ্ঠুর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কালো মেঘ। অত্যন্ত অমানবিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও একের পর এক সাজানো মামলার শিকার হয়ে তাঁকে দীর্ঘ সময় নির্জন কারাবন্দী থাকতে হয়েছে। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও বয়সের ভারে ক্লান্ত শরীরকেও রেহাই দেয়নি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। তাঁর অসুস্থতাজনিত দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তা দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল, তাঁর প্রয়াণে তা আজ এক অতল মহাসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। জিবরানের কবিতার সেই রাখাল বালকের মতো তিনিও হয়তো তাঁর প্রভুর ডাক শুনেছেন। বেগম খালেদা জিয়াও রাজরোষ আর বন্দিদশার ভয়কে জয় করেছিলেন তাঁর অমলিন আত্মবিশ্বাস আর দেশপ্রেম দিয়ে। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে প্রতিকূলতার মাঝেও মেরুদণ্ড সোজা রেখে শিরদাঁড়া উঁচু করে বেঁচে থাকতে হয়। কোনো বৈরী পরিবেশ বা একাকীত্বই তাঁর আদর্শিক অবস্থানকে টলাতে পারেনি। তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার এক অনন্য উদাহরণ, যা তাঁকে সমসাময়িক অন্য সব রাজনীতিবিদের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
বেগম জিয়ার প্রয়াণে আজ জাতি স্তব্ধ। তাঁর বিদায়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। প্রথমত, তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী এবং দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রকামী শক্তির ঐক্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর অটল মনোবল ছিল কোটি কোটি মানুষের সঞ্জীবনী শক্তি। দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর অভিভাবকত্ব ছিল অপরিহার্য। তৃতীয়ত, বিধ্বস্ত রাষ্ট্র মেরামতের জন্য তাঁর দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল এক অনন্য সম্পদ। তিনি তাঁর সর্বশেষ বক্তব্যেও প্রতিহিংসা পরিহার করে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ক্ষমার মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিহিংসা নয়, বরং ভালোবাসা দিয়ে দেশ গড়তে হবে।’ বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তরণে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সম্পদ নন; তিনি বাংলাদেশের আত্মপরিচয় এবং গণতন্ত্রের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর আদর্শ, সংগ্রাম এবং ত্যাগের মহিমা তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন একটি মহাকাব্য, যা অনাগত প্রজন্মের রাজনীতিকদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের মানচিত্র আর গণতন্ত্র যতদিন থাকবে, বেগম খালেদা জিয়ার নামও স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তিনি আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন এক অপরাজেয় ইতিহাস হয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।












