প্রিয় কন্যা,
দুই থেকে আজ তোমার তিনে পা। এই শ্রাবণ সকালে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বাবার স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠছে, দোল খাচ্ছে ’২৩ এর ২০ আগস্টের চাঁদ–তারা–জোছনা শোভিত সেই সন্ধ্যা রাতের কথা। যে রাতের ৮:১২ মিনিটে আঁধারকে ভেদ করে এক আলোকমণ্ডল দুনিয়াতে নেমে এসেছিল মিছিল করে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সেদিন গানের পাখি কোকিল পাপিয়ার দল গেয়ে উঠেছিল তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সংগীত। নিয়মের রুটিন ভঙ্গ করে সেদিন রাতে ফুটেছিল আমার নাইট কুইন। তোমার পিটপিট চোখের চাহনিতে আমার পরীর রুহানি পায়ে ভর করে দুনিয়ায় আগমনের চিত্র কী অপরূপ সৌন্দর্যে ছিল ভরা। তোমার সাথে চোখাচোখিতে আমার সে কেমন অনুভূতি জেগেছিল অন্তরে–সে এক অনন্য বিবরণ, যেন মন্ত্র পাঠ করে আমাকে মুগ্ধ করেছিল কেউ। যা দুনিয়ার ভাব–বাক্য–ভাষা বিবরণ করতে অক্ষম। দিনপঞ্জি কিংবা পিতৃত্বের ৭৩১ দিনের আয়ুষ্কালের হিসেবে তোমাকে দেখতে পাওয়া কিংবা না দেখার চেয়েও অনুভবে থাকা কন্যার মুখখানি অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট। আধো আধো স্বরে উচ্চারিত তোমার কতগুলো শব্দ আমার মস্তিষ্ক গেঁথে নিয়েছে। শব্দগুলোকে আমিও তোমার মত করেই উচ্চারণ করতে যাই–যেন কোনো এক ঘোর লেগেছে। তোমার মুখের বাবা ডাক আমার কানের চেয়েও হৃদয়টা বেশি তীক্ষ্ম ও স্পষ্ট শোনে। বাবা উচ্চারণের ব্যঞ্জনা এসে সরাসরি বুকের মধ্যখানে ঢেউ তোলে।
শোন আত্মজা,
এক অচেনা দুনিয়া থেকে এসে আমার মনের সাথে এমনভাবে মিশে গেছ–এমনটার সম্পূর্ণরূপের ব্যাখ্যা হয় কিসে? তোমার–আমার সম্পর্কটা দিন দিন গাঢ়তর হচ্ছে–তা টের পাচ্ছি। জড়িয়ে যাচ্ছি মায়ায়–তাও বুঝতে পারছি। তোমার শূন্যতা অনুভব করি ভীষণ– সেটাও মন খারাপের পশলা এসে বার্তা দেয়। তবু দূরত্ব থাকলেও মনের মধ্যে আগলে রেখে এগিয়ে যাই। একটু একটু করে তোমার বেড়ে ওঠা, হাঁটা–চলা, দৌঁড়–ঝাপ কিংবা নিজে নিজে কথা বলা দেখে বিমুগ্ধতায় ভাবি–এটাই তো সেই ছোট্টবেলার আমি। তোমার মধ্যে আমার স্পষ্ট ছায়া। আমার ছায়া হয়ে, আমাদের ছায়া পেয়ে তুমি–ই হবে আমাদেরকে পোষ–মানানোর পাখি। আমাদের আয়ুর কেতনে যে সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছ তা ঘরে–বাইরে, মনে–প্রাণে শান্তিও সুখের সুবাতাস দিচ্ছে রোজ। তোমার এই জন্মদিনে জন্মলগ্নের শুভক্ষণে পৃথিবীর যত রঙিন ফুল, আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে চলা যত সাদা মেঘ, পাহাড়ি ঝর্ণাসমূহের সম্মিলিত সুর এবং আমার মনে গহীন থেকে উত্তোলিত ভালোবাসার সব থেকে পবিত্রতম শ্বাস ও আশ্বাসটুকুন দিয়ে তোমাকে জানাই জন্মদিনে শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন। আমাদের মা–রাইসা আহমেদকে দুনিয়ার কোনো রুষ্টভাবাপন্ন ভ্রষ্টতা যেন কোনদিনও স্পর্শ না করে–প্রার্থনা করি।
আমাদের সোনা মা,
তোমার হাসিতে শুদ্ধ হয়ে যায় আমাদের মনের যত অপবিত্রতা। তোমার হাঁটা–চলা, বাক্য বলায় আমাদেরকে নতুন করে ভাবায়, নতুন পথ ও স্বপ্ন দেখায়। আমাদের যত পরিকল্পনা, পথচলা কিংবা স্বপ্ন বোনা–তা তোমাকেই কেন্দ্র করে। এখন সব সময় প্রার্থনা করি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ সুস্থ থাকে যেন সে নিত্যদিন, মাস ও বছরজুড়ে–প্রভাত বেলা ও সাঁঝের সময় চাওয়া তো এটুকুই। আমাদের দুঃখ–সুখের তরী তুমি। যেথায় ভাসাবে, যে ঘাটে বাঁধবে সেটাই আমাদের গন্তব্য। আমরা কেবল মন্তব্য দিয়ে তোমাকে ভালো–মন্দ, উচিত–অনুচিত এবং ন্যায়–অন্যায়ের পার্থক্য দেখাতে পারবো। তুমি এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুন্দরটি, সর্বাধিক উপকারীটি এবং সর্বোচ্চ আকর্ষণীয়কে বেছে নেবে। তোমার পথচলা হবে একটি সুন্দর বাংলাদেশে, যে দেশটি হবে নারীদের জন্য নিরাপদ এবং মানবিক কল্যাণ সাধন হবে সে রাষ্ট্রের লক্ষ্য–তুমি সর্বদা সত্যের সেই পক্ষে থাকবে–এইটুকুই মোর এইজনমের প্রার্থনা।
প্রিয় সন্তান,
কখনোই মায়ের অবদানকে ভুলে যাবে না বা অস্বীকার করবে না। যে ত্যাগে ও স্নেহে মা তোমাকে লালন–পালন করেছে তা কোনোকিছুর বিনিময়ে শোধ করার চেষ্টাও করবে না; কারণ তা পারবে না। এ–ই জীবনের কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। তোমার খুশির জন্য যিনি অকাতরে সৌন্দর্যের ক্ষয় করছেন, নিজের যত্ন করতে ভুলে গেছেন, আত্মীয়–স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন এবং শখ–আহ্লাদ ত্যাগ করেছেন জ্ঞাতে, তাকে তোমার ও আমার সম্মিলিতভাবে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। চিরকৃতজ্ঞতা তার প্রতি। মা তুমিও একদিন মা হবে। তোমাকে পৃথিবীতে আনার সুখে যে মা শখ করে সিজারের টেবিলে হাসিমুখে শুয়েছেন সে মা মানবজাতির সবচেয়ে সাহসী সম্পদ। মাকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করলে অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত হবে। মায়ের ত্যাগেই তুমি বড় হওয়ার সিঁড়ি পেয়েছ–কাজেই কখনোই তাকে অসম্মান বা অবহেলা নয় বরং তার বুকের মাঝে থেকে তাকেও তোমার বুকের মধ্যে রাখবে। তার সব কথা শোনা ও মানার চেষ্টা করবে। বর্ষপঞ্জির দুই পেরিয়ে তোমার তিনে শুভাগমনের ক্ষণে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আমাদের আয়ুর দ্বিগুণ করে তোমার আয়ু শতায়ু হোক।
প্রিয় সোনা মা,
বাবা হিসেবে আমার যা দায়িত্ব ছিল তার অনেককিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে। নিজেকে নিজে কোনোদিন ক্ষমা করতে না পারলেও তুমি আমায় ক্ষমা করবে। বিবেকের দংশন থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিও। কখনোই আমাকে শাস্তি দিতে তোমার হাসি বন্ধ রাখবে না। তোমার মন খারাপ দেখলে আমার হৃদয়ের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। আমার হৃদয়ের কর্তৃত্ব যে তোমার কাছেই। সবসময় হাসিখুশি থাকবে, দৌড়াবে–ঘুরবে–ফিরবে। মোটকথা, তোমাকে সারাজীবন উচ্ছলতায় উচ্ছ্বসিত দেখতে চাই। প্রাণবন্ত একটা মেয়ে হয়ে একটা ঘরকে, দুজন মানুষকে জাগিয়ে ও বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা বাবা–মেয়ের চেয়েও বন্ধু হবো বেশি। কখনো কোনো অশুভকে ভয় পাবে না। মনে রাখবে, একটা মানুষ ছায়া হয়ে তোমার পিছনে সারাক্ষণ অনুসরণ করছে। তার ছায়া তোমার মাথার ওপর তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকবে। যদি হারিয়ে যাই কোনো ঝড়ে তবুও বিশ্বাস রাখি–আমার স্রষ্টা তোমাকে ভয় থেকে মুক্ত করে নিরাপদে রাখবেন। তোমার বাবার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু আছে তারাও তোমাকে যত্ন করবেন। আশা নয় বিশ্বাস, আমার রব তার রাহমাত ও বারাকাতের চাদরে তোমাকে চিরকাল জড়িয়ে রাখবেন। কখনোই ভুলে যেও না, তিনি তোমারও রব। আমাদের বাপ–বেটির মায়া বাড়তে বাড়তে একটা মায়াময় পৃথিবীর সৃষ্টি হোক–সেই কামনায় আজ এবং নিরন্তর আগামী।
ইতিতে,
মা রাইসা আহমেদের ছোট্ট বাবা রাজু আহমেদ
raju69alive@gmail com