খোলা আকাশের নিচে কোটি কোটি টাকার পুরনো বগি

প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ, রেলওয়ে হারাচ্ছে রাজস্ব

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২৪ at ৪:২৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে রেলের কোটি কোটি টাকার পুরনো বগি খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে বছরের পর বছর। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্টযেমন হচ্ছে তেমনি চুরিও হচ্ছে। এতে রেলওয়ে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ের চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই), পাহাড়তলী, মাঝিরঘাট বাংলা বাজার, ষোলশহরসহ বেশ কিছু এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রেলের শত শত পুরনো বগি, পার্সেল বগি, রেলবিটসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। তবে রেলওয়ের এসব পুরনো বগি মজুদ করে রাখা হলেও এগুলো দেখা শুনার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এসব বগির মূল্যবান যন্ত্রাংশ প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে। আর এই চুরির সাথে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং রেলওয়ের কর্মকর্তাকর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন এবং রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির পাশে সিজিপিওয়াই এলাকায় সবচেয়ে বেশি বগি এবং রেলওয়ের যন্ত্রাংশ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। রেলের এসব পুরনো বগিসহ সকল প্রকার যন্ত্রাংশ দেখা শুনা এবং বিক্রি করার দায়িত্বে রয়েছে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অবহেলায় কোটি কোটি টাকার রেলের যন্ত্রাংশ চুরির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ের হালিশহর এলাকায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার এরিয়া নিয়ে সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডের অবস্থান। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল) রাজস্ব আয়ের প্রধান মাধ্যম। চট্টগ্রাম বন্দরের রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহনকৃত সমস্ত পণ্যকন্টেইনারসিজিপিওয়াই ইয়ার্ড হয়ে সারাদেশে যায়। এই ইয়ার্ডের পুরো এলাকাটিই অরক্ষিত।

সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডের চারিদিকে সীমানা প্রচীর দেয়ার কথা ছিলকিন্তু এখনো হয়নি বলে জানান, চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের দায়িত্বরত রেলওয়ের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর এনামুল হক সিকদার। তিনি বলেন, এটি রেলওয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ইয়ার্ড। এখানে আমরা শুধু মালবাহী ট্রেনে পণ্য পরিবহনের বিষয় গুলো দেখি। এখানে রেলওয়ের অনেক পুরনো বগি যন্ত্রাংশ মজুদ রয়েছে। এগুলো রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ দেখে। এছাড়াও এখানে আরএনবি রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সিজিপিওয়াই পুরো ইয়ার্ডে এতো বিপুল সংখ্যক সম্পদ রয়েছে কিন্তু সেই তুলনায় পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এতো বিশালগুরুত্বপূর্ণ ইয়ার্ডটি চলছে শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যা লোকবল নিয়ে। সীমানা প্রচীর না থাকায় পুরো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এই ব্যাপারে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, সিজিপিওয়াই হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয়ের হৃদপিন্ড। এখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সকল কন্টেইনারবাহী ট্রেন পরিচালিত হয়। এছাড়াও এই ইয়ার্ডের চার পাশে রেলওয়ের শত শত পুরনো বগিসহ কোটি কোটি টাকার লোহা জাতীয় জিনিস রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই এরিয়ার চারপাশে অনেক আগেই সীমানা প্রাচীর দেয়া উচিত ছিল। এখানে পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বিভাগ বারবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সীমানা প্রচীর নির্মাণের জন্য চিঠি দিলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) ঘিরে রেলের যন্ত্রাংশ চুরির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মূলত এখানকার সংশ্লিষ্ট উপসহকারী প্রকৌশলী, ম্যানেজার, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সিজিপিওয়াই চৌকির সিআইসহ মিলে রেলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ বিক্রির এই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন। সরেজমিনে দেখা গেছে, এখানে ট্রেনের বগি এবং ওয়াগন গুলোর মূল্যবান যন্ত্রাংশ গুলো রাতে আধারে চোরাকারবারী সিন্ডিকেট নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র বগি গুলো পড়ে আছে। চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের মতো একই অবস্থা কদমতলী, পাহাড়তলী, মাঝিরঘাট বাংলাবাজার, ষোলশহর এলাকাও। এখানে পড়ে থাকা পুরনো বগি থেকে সকল মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গেছে। শুধুমাত্র বগি গুলো পড়ে আছে। রেলের যন্ত্রাংশ চুরির পাশাপাশি রেলের এই ইয়ার্ডে তেল চুরির সিন্ডিকেটটি আরো বেপরোয়া বলে জানান স্থানীয়রা। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ আরএনবি এবং ম্যানেজারের যোগসাজসে একদিকে যেমন রেলের যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে প্রতিনিয়ততেমনি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার তেল চুরি করে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে এই ইয়ার্ড থেকে।

চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই)-এর পাশেই একাধিক রেলের তেল চুরির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়তলী রেলওয়ে সেইল ডিপো থেকে নিয়মিতই রেলের দামি দামি যন্ত্রাংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে প্রতিনিয়তই রেলের এসব পুরনো যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বছরের পর বছর সকল স্ক্র্যাব একটি সিন্ডিকেটই নানান রকম যোগসাজশে নিয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবে যিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি এই সিন্ডিকেটের বাইরে যেতে পারেন না। এই চিহ্নিত সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে যান।

সরেজিমনে গিয়ে দেখা যায়, ষোলশহর রেল স্টেশনের পেছনে এবং দুইপাশে বছরের পর বছর পরিত্যক্ত ভাবে পড়ে আছে রেলের বিপুল পরিমান পার্সেল বগি, রেলবিটসহ মূল্যবান সামগ্রী। রেল স্টেশনের পাশ ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ৫শ’র বেশি অবৈধ বস্তিঘর। দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশনের পেছনে এবং দুইপাশে ময়লার ভাগাড়।

স্টেশনে কর্মরত এক কর্মচারী আজাদীকে জানান, স্টেশনের আশপাশে বস্তিতে মাদক বিক্রি হয়। মাদক সেবীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকা। স্টেশনের পেছনে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে লাখ লাখ টাকা রেলের পার্সেল বগি। স্টেশনের কর্মকর্তাকর্মচারীরা জানান, প্রতিনিয়ত একটি চক্র রেলের এসব বগিসহ যন্ত্রপাতি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন এবং রেলওয়ে পুলিশআরএনবি কোন উদ্যোগই নিচ্ছেন না বলে জানান স্টেশনের কর্মকর্তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিস্ফোরণের শব্দে টেকনাফের ঘরবাড়িতে ফাটল
পরবর্তী নিবন্ধঘুমের মধ্যে বিষধর সাপের কামড়, প্রাণ গেল স্কুলছাত্রীর