সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্র্যালোচনায় দেখা যায়, ঋণ পুনর্গঠন–পুনঃতফসিল–আংশিক এককালীন পরিশোধে বিশেষ ছাড়সহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পরও চলতি বছরের শুরু থেকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে পরিচালন ব্যয়। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব অতিশয় দৃশ্যমান। বিগত সরকারের শাসনামলে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি–রাজনীতিকের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ঘৃণ্য লুটেরা বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখল করেছিল। ব্যাংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় পরিবার–স্বজন ও নিকটআত্মীয় সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। পছন্দের ব্যক্তিদের বিশাল অঙ্কের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে অনৈতিক সুবিধার প্রচলন ছিল অবারিত। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল অসৎ–অযোগ্য ও নষ্ট চরিত্রের কিছু কুৎসিত মানুষগুলো। প্রায়ক্ষেত্রে দানবরূপী এদের চরিত্র সচেতন মহলের কাছে উন্মোচিত ছিল। অর্থ–ক্ষমতালিপ্সু, হিংস্র নরপশুতুল্য মানুষগুলোর আত্মতৃপ্তির কোন চৌহদ্দী ছিল না। যেকোন ঘৃণ্য অবৈধ–অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্যক্তিস্বার্থে লোভলালসা চরিতার্থে জনগণের জমাকৃত অর্থ–সম্পদ লুণ্ঠনে তারা বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেনি। ধর্মপ্রীতি–মৃত্যুভয়–পাপপুণ্য, দেশ–মানবপ্রেম কোন ধরনের অনুভূতি এই কদাচার মানুষগুলোকে স্পর্শ করেনি।
বিশেষ কিছু ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করে ঋণ গ্রহণের নানামুখী কদর্য প্রক্রিয়ায় পুনরায় ঋণ প্রাপ্ত হয়েছে। পুনঃতফসিলকরণের নামে সুদমুক্তি এবং অধিকমাত্রায় ঋণ প্রদানের অপসংস্কৃতি দেশের অর্থব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি খাত এদের অভিশপ্ত প্রভাবের করায়ত্ত ছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বৃহৎ ব্যাংকে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এতে অর্থ লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সচেতন লেখক–সাংবাদিক–কলামিস্টরা এসব বিষয়ে প্রচুর লেখালেখিও করেছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এসবের কিছুই আমলে না নিয়ে অপরাধীদের অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেশ বিধ্বংসী এতসব কর্মযজ্ঞের কোনো বিচার হয়নি। উপরন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি–হস্তক্ষেপ–সংস্কার কোন কিছুতেই খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যায়নি। ফলে দিন দিন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
২৩ এপ্রিল ২০২৫ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে। তাছাড়া মূলধন স্বল্পতা, পরিচালন অদক্ষতা, সুশাসনের ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপকে কুক্ষিগত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং সুবিধাভোগীদের মধ্যে ঋণ আদান–প্রদানের গড়ে ওঠা ব্যবস্থা বছরের পর বছর ব্যাংক খাতের সক্ষমতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আইনি ফাঁকফোকরের মাধ্যমে পারবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নানা ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই খাতের দুর্বলতাগুলো আমলে নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে এ খাতের দুর্বলতাগুলো একে একে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের লাগামহীন উর্ধ্বগতি ব্যাংক খাতে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত। বিগত বছরের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বিপুল প্রচারিত। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে বেনামে ঋণ গ্রহণের বিপরীতে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। এটি মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ফলে অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪২ দশমিক ৮৩ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আপাতত ভালোর দিকে যাবে না। যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেভাবে ধরণা দিয়েছিলাম, সেভাবে বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে।’
খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত উর্ধ্বগতির ফলে ব্যাংকগুলোর অকার্যকর সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি কমছে মূলধনের হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় প্রকাশ পায় যে, ২০২৪ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকগুলোর চেয়ে সম্পদ বা ঋণ কিংবা বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কমতে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলো বিদেশি বিনিয়োগসহ সামগ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবের সম্মুখীন। দেশের ১৬টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পুরো ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। উক্ত সময় পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট মুলধনের অনুপাত (এআরএআর) ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে যা গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এই হার ১০ শতাংশের বেশি থাকা বাধ্যতামূলক। ২০২৩ সালে ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে সম্পদ থেকে দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ১০০ টাকায় ৫৯ পয়সা আয় হলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছে দশমিক ৩৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে এ খাত থেকে আয় কমেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ আদায় করা হচ্ছে না। খেলাপি ঋণের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে ও খেলাপি ঋণ নবায়নে নানা ছাড়ের কারণে এ খাত থেকে আয় কমে গেছে। এতে আরও বলা হয়, জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১১টি ব্যাংক এ খাত থেকে কোনো আয়ই করতে পারেনি। ৫ শতাংশের কম আয় করেছে ২০টি ব্যাংক। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম আয় হয়েছে ১০টি ব্যাংক ও ১০ শতাংশের বেশি আয় করেছে ২০টি ব্যাংক।
২৭ এপ্রিল ২০২৫ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ইতিমধ্যেই ৮১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আড়াল করার এই অপসংস্কৃতি ব্যাংক খাতকে অধিকতর দুর্বল করছে। বিগত ২১ বছরে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৪টি ব্যাংক ঋণ অবলোপনের নজির স্থাপন করেছে। দেশের শীর্ষ ১০টি ব্যাংকেই অর্ধেকের বেশি ঋণ অবলোপনের চিত্র প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পূঞ্জীভূত অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে একই সময়ে যা ছিল ৭১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের অবলোপন বেড়েছে ৯ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ২৫ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা।
বিজ্ঞজনদের মতে, ব্যাংক খাতে এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বিচারহীনতা। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক আশ্রয়ে ঋণ নিয়েছে। যা ফেরত না দিয়েও দায়মুক্তি পেয়েছে এবং দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। পাশাপাশি কতিপয় পরিচালক পুরো ব্যাংক খাতকেই নষ্ট করে দিয়েছে। উল্লেখ্য কদর্য চরিত্রের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নামে–বেনামে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগও রয়েছে। এই অর্থ ফেরত না আসায় দেশের মুদ্রা সঞ্চালন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এখন সেই ঋণগুলো খেলাপি হয়ে ক্যান্সারের রূপ ধারণ করেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ঋণ আদায়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো হতো যদি তাদের জামানতগুলো বিক্রি করে দেওয়া হতো। কিন্তু ঋণের বিপরীতে তারা যে সম্পদ জামানত রেখেছে তা দিয়ে ১০ শতাংশ টাকাও আদায় করা সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপিদের সকল প্রকার স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ঋণ সমন্বয় করাই হবে উৎকৃষ্ট উদ্যোগ। উদ্ভূত সংকট নিরসনে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে বাড়াতে হবে ব্যাংকগুলোর নজরদারি। একই সাথে পুনঃমূলধনীকরণ, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং মুনাফা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত আবশ্যক।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী