খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির লাগাম টানতে হবে

| বুধবার , ৩১ মে, ২০২৩ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। দৈনিক আজাদীতে গত ২৯ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২২ সালের মার্চ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, মার্চ প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা সরকারি ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মার্চ প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। এ সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে (ঋণ স্থিতি) ১১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

মার্চ প্রান্তিকে দেশে কর্মরত বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো ৩ হাজার ৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার ২৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। দুই বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ। ব্যাংক দুটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭৩১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক দুটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে (ঋণ স্থিতি) ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থ ঋণ আদালতগুলোয় বর্তমানে প্রায় পৌনে এক লাখ খেলাপি ঋণের মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। ফলে একদিকে যেমন ঋণ আদায়ে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না, তেমনি খেলাপির সংখ্যা আরও বড় হচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হয়েছে? মামলার দীর্ঘসূত্রতায় ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে রয়েছে, সেজন্য এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন কয়েকজন কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ ঋণ আদালতের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের অর্থ ঋণ আদালতগুলোয় খেলাপি ঋণের অভিযোগে ৭২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় আটকে রয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ, ঋণ আদায় বা এ জাতীয় বিষয়ে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হয়। ২০০৩ সালে এ আদালত গঠনের পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এতে মোট মামলা হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার। সেসব মামলায় দাবি করা অর্থমূল্য ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্ট এবং আইনজীবীরা বলছেন, কয়েকটি কারণে অর্থ ঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে।

তাঁরা বলছেন, যখন ব্যাংকগুলো বুঝতে পারে যে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আর খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না, চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসাবে তারা মামলায় যায়। আবার অর্থ ঋণ আদালতে কোন মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্যও আরেকটি মামলা করতে হয়।

খেলাপি ঋণকে ‘অর্থনীতির শত্রুহিসেবে গণ্য করে সরকার খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে চান বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেন, ঋণ খেলাপের মামলাজট দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অবশ্যই এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ বাড়ার লাগাম টানতে হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বারবার তাগিদ দিচ্ছে এ ব্যাপারে। তারা আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও সংশ্লিষ্ট রাজস্ব খাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছিলেন। আর সেজন্য ব্যাপক, বিশ্বাসযোগ্য ও নির্দিষ্ট সময়ের কর্মপরিকল্পনা নিতে বলেন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল না করলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদেরকে দমনের জন্য ‘কসমেটিক পরিবর্তনসমূহ’ কোনো কাজ দেবে না। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের মধ্যে ব্যাংকের মালিক, পরিচালক, বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাই যেহেতু সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়ার একচ্ছত্র সুবিধা ভোগ করে চলেছেন তাই তাদের সুবিধাগুলো কাটছাঁট করে খেলাপিঋণ কমানো যেতে পারে বলে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ধারণা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারের প্রস্তাবিত ‘কসমেটিক পরিবর্তনগুলো’ এতদুদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। কিন্তু, ট্রাইব্যুনাল করা হলে ‘যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল’ প্রক্রিয়ারই আশ্রয় নেয়া যেতো। এই ব্যাপারটি যে নীতিপ্রণেতাদের চিন্তাচেতনায় আজো স্থান পেলো না সে দুঃখ কোথায় রাখি? তাই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে