খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল অপ্রত্যাশিত

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৩ মে, ২০২৫ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

অতিসম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ইতিমধ্যেই ৮১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আড়াল করার এই অপসংস্কৃতি ব্যাংক খাতকে অধিকতর দুর্বল করছে। বিগত ২১ বছরে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৪টি ব্যাংক ঋণ অবলোপনের নজির স্থাপন করেছে। দেশের শীর্ষ ১০টি ব্যাংকেই অর্ধেকের বেশি ঋণ অবলোপনের চিত্র প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পূঞ্জীভূত অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে একই সময়ে যা ছিল ৭১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের অবলোপন বেড়েছে ৯ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ২৫ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। তাছাড়া বেসরকারি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অবলোপনের পরিমাণ যথাক্রমে ৫২ হাজার ৭৮০ কোটি, ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ও ৬১৩ কোটি টাকা।

শীর্ষে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু সোনালী ব্যাংকই করেছে ৮ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংক ৫ হাজার ৬২৭ কোটি, জনতা ব্যাংক ৫ হাজার ১২৬ কোটি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ঋণ অবলোপনের চর্চা ২০০৩ সাল থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। বিধি মতে ঋণ অবলোপনের পূর্বেই অর্থঋণ আদালতে মামলা অপরিহার্য। খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা প্রভিশন সংরক্ষণ করাও বাধ্যতামূলক। বিজ্ঞ মহলের মতামতে এটি সুস্পষ্ট যে, নীতিমালা শিথিল করার কারণে ঋণ অবলোপন ক্রমাগত বেড়ে চলছে। ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমাতে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ অবলোপনের দিকে ঝুঁকছে। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের দাবি, ঋণ অবলোপনসহ বিভিন্ন পদ্ধতি আড়াল করা ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

আমাদের সকলের জানা, বিগত সরকারের সময়কালে কাগজে কলমে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে পূর্বের শর্ত শিথিল করে নতুন ঋণ অবলোপন নীতিমালা ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সালের মধ্যে সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঋণের শ্রেণিমান যাই থাকুক না কেন, কোনো মৃত ব্যক্তির নিজ নামে বা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ থাকলে ব্যাংক সেই ঋণ অবলোপন করতে পারবে। তবে একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উপার্জনক্ষম উত্তরসুরি রয়েছে কি না, তা বিবেচনায় নিতে হবে। এতে আরও বলা হয়, ঋণের বিপরীতে বন্ধকিকৃত সম্পত্তি নিয়ম মেনে বিক্রয়ের চেষ্টা গ্রহণ করা হলে এবং ঋণের নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তির কাছে পাওনা অর্থ আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেই ঋণ অবলোপন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অবলোপনের আগে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করতে হবে। তবে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং মৃত ব্যক্তির ঋণ মামলা দায়ের ছাড়া অবলোপন করা যাবে।

১১ এপ্রিল ২০২৫ প্রকাশিত গণমাধ্যম প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের লাগামহীন উর্ধ্বগতি ব্যাংক খাতে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত। বিগত বছরের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি অতিশয় দৃশ্যমান। ২০২৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর এ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়। প্রতিবেদনে আরও প্রতিফলিত যে, গত ডিসেম্বর শেষে তফশিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা এবং জুনে ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পাঁচটি ব্যাংকের কাছেই আছে মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরমিাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৫১ শতাংশ। পক্ষান্তরে দেশের বাকি ৫৬ টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বা মোট খেলাপি ঋণের ৪৯ শতাংশ। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বিগত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট, দখলদারিত্ব ও অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলো থেকে দেওয়া অনেক ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আগে এই সমস্যাগুলো গোপন রাখা হলেও সরকার পরিবর্তনের পর তা প্রকাশ পেতে শুরু করে। ফলে প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

খেলাপি ঋণের উল্লস্ফনে মূলধন ঘাটতি ও আয় কমে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলো বিদেশি বিনিয়োগসহ সামগ্রিক ব্যবসাবাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবের সম্মুখীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের জুলাইসেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্যসূত্রে দেখা যায়, দেশের ১৬টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পুরো ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। উক্ত সময় পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট মুলধনের অনুপাত (এআরএআর) ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে যা গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এই হার ১০ শতাংশের বেশি থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা তহবিল (প্রভিশন) বেশি সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা মূলধন সংকট তৈরি করছে। ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে বাড়াতে হবে ব্যাংকগুলোর নজরদারি। একই সাথে পুনঃমূলধনীকরণ, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং মুনাফা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

উদ্ভূত এসব সমস্যার সমাধানকল্পে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বাপেক্ষা বেশি জালিয়াতি হওয়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়া ও আর্থিক খাত সংষ্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠনসহ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে চলমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও ব্যাংকব্যবস্থায় বিদ্যমান ব্যাপক তারল্য সংকট সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত নানাবিধ কর্মপন্থা এবং বিশেষ তারল্য সহায়তার কারণে ব্যাংক খাতে সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস সমাপ্তে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তরল সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর মাসে যা ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক খাতে সকল ধরনের আমানত ও ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে একদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। অন্যদিকে আমানতের সুদের হার বাড়ায় গ্রহকরা সঞ্চয়ে আগ্রহী হচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রহকদের আস্থা ফিরে আসছে।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্ত ও চূড়ান্ত করার পর এ সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) রিপোর্ট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে সিআইবিতে ডব্লিউ ডি বা উইলফুল ডিফল্ডার হিসেবে প্রদর্শন করতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চূড়ান্ত গ্রাহককে এই বিষয়ে পত্র দেওয়ার সময় যাচাই করা তথ্যসহ সিআইবিকে সরবরাহ করতে হবে। ব্যাংক থেকে তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের পুঞ্জীভূত তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বিবরণী আকারে প্রতি তিন মাস পরপর পরবর্তী মাসের দশ তারিখের মধ্যে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে দাখিল করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, ঋণ খেলাপি উৎসাহিত করার সকল পন্থা পরিত্যাজ্য। অবলোপনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ শিথিল করা অবিবেচক হবে। বর্তমান সরকারের অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো প্রায়োগিক বাস্তবায়নে অধিকতর মনোযোগ আবশ্যক।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজঅপরাধবিজ্ঞানী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে ছাত্রদলের উদ্যোগে পরীক্ষার্থীদের মাঝে খাবার পানি বিতরণ