রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে বাতিল করতে চাইলে তা নির্বাচনের মাধ্যমে করা সবচেয়ে সহজ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে বাতিল হলে তা হবে পার্মানেন্ট (স্থায়ী)। অন্য বাতিলে কাজ হবে না। অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় বাতিলে গেলে সেটা সাময়িক কাজ করবে; দীর্ঘমেয়াদে করবে না। আওয়ামী লীগকে জনগণ বাতিল করলে সেটাই হবে আসল বাতিল। আমাদের ওদিকে যেতে হবে। এ সময় যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি নির্বাচিত সরকার দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গতকাল সোমবার বিকালে নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা, পেশাজীবী সমাবেশ ও নবনির্বাচিত মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী ও এ্যাব চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার জানে আলম সেলিমের সঞ্চালনায় সংবর্ধিত অতিথি ছিলেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ।
দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করছে দাবি করে আমীর খসরু বলেন, মানুষ তার নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষা করছে। যে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার জনগণের কাছে জবাব দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। অন্য কোনো সরকার দায়বদ্ধ থাকবে না। কারণ তাদের তো জনগণের কাছে যেতে হবে না। কিন্তু বিএনপিকে যেতে হবে। যারা রাজনীতি করে তাদের যেতে হবে। সুতরাং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে অতিসত্বর একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি ও সরকার নির্বাচিত করতে হবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক খেলাধুলা চলছে মন্তব্য করে খসরু বলেন, অনেকে আমাকে বলেন দেশে আবার কি শুরু হয়েছে? স্বৈরাচার চলে গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, আমাদের কি এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হবে? আমি বলেছি, চিন্তার কোনো কারণ নেই। খেলাধুলা যারা করছে তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না। তারা বিএনপির শক্তি বুঝতে পারছে না। এই বিএনপি সেই বিএনপি নয়। এই বিএনপি অনেক শক্তিশালী অবস্থানে। এর শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। এই বিএনপিকে টলানোর সাধ্য কারও নেই। বিএনপির কয়েকটা সিদ্ধান্ত তো আপনারা ইতোমধ্যে দেখেছেন। সুতরাং এ রকম সিদ্ধান্ত দিলে এ অবস্থায় যেতে হবে।
তিনি বলেন, বিএনপিকে জোর করে ক্ষমতার বাইরে রাখার তাদের যে ভাবনা ছিল, ওই ওয়ান ইলেভেনের বিরাজনীতিকরণ; আবার নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা। ক্ষমতার স্বাদ তো কেউ কেউ পেয়েছেন। মনে রাখছেন এ ক্ষমতা ধরে রাখলে মন্দ কি। কিন্তু এ স্বাদ পাবার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মানুষ তার মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য ১৬ বছর যুদ্ধ করেছে।
খসরু বলেন, বিএনপিকে ভাঙার সব ধরনের চেষ্টা হয়েছে। খুন, মিথ্যা মামলা সব হয়েছে। জেলে রেখে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার চেষ্টার মধ্যেও দেশনেত্রী টলেননি, তারেক রহমান টলেননি, বিএনপির নেতাকর্মীরা কেউ টলেননি। সবার অবস্থান শক্ত। তিনি বলেন, আমরা গত ১৫–১৬ বছর ধরে কঠিন সময় অতিক্রম করেছি। আমাদের নেতাকর্মীদের গুম–খুনের শিকার এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছে পুলিশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে। এতে ত্যাগ করতে শিখেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ ত্যাগের মাধ্যমে তারা জ্বলে–পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের আর কারও কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা অনেক কষ্ট করেছি, আমাদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট হলেও, সময় কঠিন হলেও এটা কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে অনেক উপরের লেবেলে নিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি জাতীয় ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সংস্কার করতে চায় তাতে আমাদের আপত্তি নেই। যেখানে ঐকমত্য হবে না সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আগামী নির্বাচনের আগে মানুষের কাছে যাবে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রস্তাব পাস করলে কোনো অসুবিধা নেই। এটাই তো নিয়ম। তারপর সংসদে সেটা পাস হবে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করলে সংসদে তো সেটা আবার রেটিফাই করতে হবে। সুতরাং যেটুকু করতে পারেন, আমাদের আপত্তি নেই। এর মধ্যে ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে যদি দশটা সংস্কার করতে পারেন তাহলে আমরা রাজি আছি। আর বাকিগুলো জনগণের কাছে যাবে, জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি বলেন, যত ধরনের সংস্কারের কথা আমরা আলাপ করছি, সেটা রাজনীতিবিদরাই পূরণ করবে। আমাদের ৩১ দফার মধ্যে আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি। সংস্কারের কথা বলছেন, দেশনেত্রী ছয় বছর আগে ভিশন টুয়েন্টি–থার্টিতে সংস্কারের কথা বলেননি? তখন তো কারও মুখে সংস্কারের কথা শুনিনি। কারণ দেশনেত্রী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে সেটা উনি ছয় বছর আগে উনার ভিশনের মধ্যে পরিষ্কার করেছিলেন। তারেক রহমান এক বছর আগে একত্রিশ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন শেখ হাসিনারও পতন হয়নি, এত বড় বড় বিশ্লেষকদেরও আবির্ভাব হয়নি। সেই একত্রিশ দফায় বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যে ধরনের সংস্কারের দরকার, সবকিছু স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
খসরু বলেন, সংস্কারের জন্য আমরা জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা দায়বদ্ধ জাতির কাছে। ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি একা করেনি। ৪২টি দল, যারা আমাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল, আমরা সবাই মিলে করেছি। অর্থাৎ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা ৩১ দফা করেছি। আমরা ৪২টা দল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জাতির কাছে এ সংস্কার করার জন্য। আপনারা কতটুকু পারবেন, কি করবেন জানি না; কিন্তু আমরা পারব, আমরা করব। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তিনি বলেন, শুধু ৩১ দফা দিয়েই বিএনপি সবকিছু শেষ করেনি। তারেক রহমান এ ৩১ দফা কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। অর্থাৎ নির্বাচনের পরে জনগণ যদি আমাদের রায় দেন, তারেক রহমান বলেছেন বিএনপি একা সরকার গঠন করবে না। বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে। এ জাতীয় সরকার ৩১ দফা সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। আমরা যারা ৩১ দফা প্রস্তুত করেছিলাম, জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই মিলে ৩১ দফা সংস্কার বাস্তবায়ন করব। সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। কিছু বাকি নেই।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে নির্বাচনী সংস্কার। সব কথা শুনছি, নির্বাচনী সংস্কারের কথা শুনছি না। একটা কমিশন গঠন করেছে, আমরা খুশি হয়েছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরাও কিন্তু নির্বাচনী সংস্কারের জন্য সবকিছু তৈরি করে রেখেছি।
তিনি বলেন, আমাদের সংস্কার তো আজকের না, বাংলাদেশ আগামী দিনে কি হবে, সেটা নিয়ে আমরা বহুদিন ধরে কাজ করছি। ক্ষমতায় যেদিন বিএনপি বসবে, সেদিন থেকে ইনশাল্লাহ সংস্কার কাজ শুরু হবে। বিচার বিভাগের সংস্কার যেদিন থেকে বিএনপি বসবে ওইদিন থেকে শুরু হবে। একটা দিনও আমরা নষ্ট করব না। শিক্ষাখাত, ব্যবসায়ীদের বিষয়, সব খাতের সংস্কার, সবকিছু প্রস্তুত। ডে ওয়ান থেকে সংস্কারের কাজ শুরু হবে। আর কারা কি করবে আমরা জানি না, আমরা কি করব সেটা আমরা জানি। আগামী দিনে বিএনপি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশ নিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে, দেশকে সেখানে নিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পলায়ন করার পরে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের মনোজগতের বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই মনোজগতের পরিবর্তনে জনগণ যে স্বপ্ন দেখছে, রাজনীতিবিদরা যদি সেই স্বপ্ন না দেখে, তাহলে সেই রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বিএনপি এটা বুঝেছে, অনুধাবন করেছে, ধারণ করেছে এবং এটা শতভাগ প্রয়োগ করে দেশের মানুষের, নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ থেকে স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু তার দোসররা আমাদের মাঝে আছে, সমাজে আছে। এ দোসরদের যদি আমরা চিহ্নিত করতে না পারি তাহলে সত্যিকার অর্থে যে মূল্যবোধ আবু সাইদ, মুগ্ধ, ইলিয়াছ আলী, চৌধুরী আলম সৃষ্টি করেছেন, কোনো কিছুই আদায় হবে না, যদি দোসরদের আইনের কাঠগড়ায় না আনতে পারেন। তাদের ক্ষমতার যে দম্ভ অর্থাৎ মানুষের লুণ্ঠনকৃত টাকা, আইন–বেআইনি অস্ত্র, সেগুলো যদি উদ্ধার এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে না পারে তাহলে সকল শহীদের রক্ত বৃথা যেতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর এখন নাটক করছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। কোনো লজ্জা নেই পালিয়ে গেলেন। এরপরও অডিও দেন, ভিডিও দেন, বিভিন্ন কথা বলেন। কতক্ষণ পরে বলেন স্থগিত করা হলো, অর্থাৎ নাটক চলছে। দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই।
চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য, দিশেহারা, তখনই জিয়াউর রহমান উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। এমনি এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে তিনি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয় আসলেই জিয়াউর রহমানের নাম আসবে। শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়ক। কেউ চাইলেই এই ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ ইতিহাস লিখেন ইতিহাসবিদরা। রাজনীতিবিদরা ইতিহাস রচনা করলে সেটা হয় প্রোপাগান্ডা।
এরশাদ উল্লাহ বলেন, ছাত্র–জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। এজন্য গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের পথ আজ প্রশস্ত হয়েছে। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান পরবর্তী সময়ে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেশাজীবীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে কোনোভাবেই নস্যাৎ হতে দেওয়া যাবে না।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. নাজিম উদ্দীন চৌধুরী, চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. নসরুল কদির, ড্যাব চমেক শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. জসিম উদ্দীন, সিএমইউজের সভাপতি সাংবাদিক মো. শাহনেওয়াজ, চট্টগ্রাম জেলা ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. তমিজ উদ্দীন আহমেদ মানিক, ড্যাব মহানগর সভাপতি অধ্যাপক ডা. আব্বাস উদ্দীন, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি এম এ সাফা চৌধুরী ও ব্যাংকার মেহরাব হোসেন খান।