এক সময় রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন গ্রামের সড়কজুড়ে দেখা যেতো সারি সারি খেজুর গাছ। শীতের সকালে গাছ থেকে কলসি নামিয়ে বিক্রির ধুম পড়তো খেজুর রসের। উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে রস বিক্রি হতো আশেপাশের উপজেলাতেও। এমনকি উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে রস থেকে গুড়ও তৈরি করে তা বিক্রি করতে দেখা যেতো।
কিন্তু রসের চাহিদা অক্ষুণ্ন থাকলেও একসময়ে খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত রাঙ্গুনিয়ায় একেবারে কমছে খেজুর গাছ। এমনকি এই পেশার সাথে জড়িত গাছিরাও ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। তবে উপজেলা কৃষি বিভাগ বলছে ঐতিহ্য রক্ষায় প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির সময় বিশেষ গুরুত্বসহকারে তাল ও খেজুর গাছ রোপণ করানো হচ্ছে।
গাছিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নগরায়ণের ফলে রাঙ্গুনিয়ার মুখরোচক খেজুর রস এখন পাওয়া দুষ্কর। গুটিকয়েক গাছি পুরাতন এই পেশা এখনো ধরে রেখেছেন। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অর্ধশত গাছি এখনো এই পেশায় জড়িত। উপজেলার পদুয়া, সরফভাটা মীরেরখীল, শিলক, বগাবিলি, দক্ষিণ রাজানগর, নিশ্চিন্তাপুর, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, পারুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন খেজুর রস পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর তা ক্রমশ কমে আসছে বলে জানান তারা।
কথা হয় উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের মীরেরখীল গ্রামের গাছি শামসুল আলমের (৬৫) সাথে। তিনি জানান, গেল ত্রিশ বছর ধরে তিনি এই পেশার সাথে জড়িত। বাপ–দাদার ধারাবাহিকতায় তিনি এই পেশাকে ধরে রেখেছেন। এ বছর তিনি চার হাজার টাকার বিনিময়ে একজন থেকে ২৫টি গাছ নিয়েছেন। প্রতিদিন ১৫–২০ লিটার রস পেয়ে থাকেন বলে জানান তিনি। উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের কৃষক আবুল কাশেম এবার ৭০টি গাছ নিয়েছেন। সারাবছর তিনি কৃষি কাজ করেন। তবে শীতকাল এলেই অন্য কাজ বাদ দিয়ে খেজুরের রস বিক্রি করেই সংসার চালান তিনি। রস বিক্রি করেই প্রতি মৌসুমে আয় করেন অর্ধলাখ টাকা। তিনি জানান, শীতের শুরুতেই খেজুর গাছ কাটা শুরু করেন। রসের প্রচুর চাহিদা। প্রতিদিন ভোরে রস সংগ্রহ করে গাছ থেকে নামাতেই বিক্রি হয়ে যায়। বাজারে নিয়ে যেতে হয় না, বাজারে যাওয়ার পথেই বিক্রি হয়ে যায়। এমনকি অগ্রিম অর্ডার নিয়েও রস দিতে পারেন না অনেকে। এই পেশায় ঝুঁকি অনেক বলে জানান কাশেম।
নিশ্চিন্তাপুর এলাকার গাছি বাদল মিয়া বলেন, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে তাতে এক সময় হয়তো আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ থাকবে না। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। আমি প্রতি মৌসুমে রস সংগ্রহ করি। তাছাড়া অন্য মৌসুমে মোটামুটি চাষবাস করেই আমার দিন পার হয়।
বেতাগী ইউনিয়নের গাছি আবদুর রহমান জানান, প্রতি লিটার খেজুরের কাঁচা রস বিক্রি হচ্ছে ৯০–১০০ টাকায়। প্রতিদিন প্রায় ১২ থেকে ১৫ লিটার রস বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন রস বিক্রি করে এক দেড় হাজার টাকার মতো আয় করেন।
পোমরা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক নুরুল হুদা মাস্টার বলেন, এক সময় খেজুর রসের জন্য রাঙ্গুনিয়া বিখ্যাত ছিল। এখন গাছ নেই বললেই চলে। যা আছে, সেগুলো থেকে আগের মতো রস পড়ে না। ফলে ঐতিহ্যের খেজুর রসের প্রচুর চাহিদা থাকা স্বত্ত্বেও দিন দিন তা বিলুপ্তির পথে বসেছে। খেজুর গাছ রক্ষায় সকলকে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস জানান, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খেজুর গাছ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে রসের খুব চাহিদা রয়েছে, চাহিদা রয়েছে খেজুরের গুড়েরও। তাই প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ করার সময় তাল ও খেজুর গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে রাঙ্গুনিয়ার এই ঐতিহ্য রক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।