খুনের সঙ্গে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ছিল নেশা ও পেশা

ওসি প্রদীপ

| মঙ্গলবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হতো। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি।
প্রদীপকে নিয়ে এই ভাষ্য খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর, যা বলা হয়েছে সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে। র‌্যাবের দেওয়া এই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অপরাধ কর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ।
২০১৬ সালে কক্সবাজারের মহেশখালী থানার এবং তার দুই বছর পর টেকনাফ থানার ওসির দায়িত্বে থাকা প্রদীপের একের পর এক খুন চালিয়ে যাওয়ার তথ্যগুলো সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরই প্রকাশ পায়। অথচ তার আগে টেকনাফে মাদক প্রতিরোধের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম পেয়ে বাহিনীতে উচ্চ প্রশংসায় ভাসছিলেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
কক্সবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে থাকাকালেও নানা অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর ও একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেসব অভিযোগ অতটা বড় হয়ে উঠেনি ২০২০ সালের ৩১ জুলাইয়ের আগে, যেদিন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া এলাকায় তল্লাশি চৌকিতে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা।
ব্যাপক আলোচনা ওঠার পর পুলিশ থেকে বরখাস্ত হয়ে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট আদালতের মাধ্যমে প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কঙবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক সাংবাদিকও প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে। ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা। প্রদীপকে নিয়ে বলা হয়েছে সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে। বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে ২০০৪ সালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন। এরপর আরও নানা ঘটনায় বিতর্কিত হলেও তার ঔদ্ধত্য থামেনি। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ বাহিনী থেকে বরখাস্ত হন তিনি।
সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পরের সপ্তাহেই তার বিরুদ্ধে ভিন্ন ঘটনার প্রথম মামলাটি হয় সাড়ে তিন বছর পর আগের একটি ঘটনায়। ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নে দুই জলদস্যু বাহিনীর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় আব্দুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। সাত্তারের স্ত্রী হামিদা আক্তার বাদী হয়ে ওসি প্রদীপ ও আরও ৫ পুলিশ সদস্যসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় জলদস্যু ফেরদৌস বাহিনীর প্রধান ফেরদৌসকে।
২০১৭ সালে ঘটনার পর প্রদীপ যখন মহেশখালীর ওসি, তখন মামলা নেওয়া হয়নি বলে বাদীর অভিযোগ। একই ঘটনায় একটি রিট আবেদন তখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায় মহেশখালীর আদালত অভিযোগটি খারিজ করে দেয়। তবে এ ঘটনায় পুলিশের করা মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
এক পরিবারের ৩ জনকে হত্যা : সিনহা খুনের আগের মাসে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের এক পরিবারের তিনজনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট প্রদীপসহ ৩৫ পুলিশ সদস্য ও আরও ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহত ছৈয়দ আলমের স্ত্রী সুলতানা রাবিয়া মুন্নী।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী গাজী পাড়ার বাসিন্দা ছৈয়দ আলমের স্ত্রী। তার অভিযোগ, ওই বছরের ৬ মের রাতে ছৈয়দ আলম, তার ভাই নুরুল আলম ও ভাগিনা আব্দুল মোনাফকে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে তুলে নেওয়া হয়। তখন তাদের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল। টাকা না দেওয়ায় বাড়ির পাশের পাহাড়ের নিচে ধানক্ষতে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের ‘নাটক সাজিয়ে’ গুলি চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়। খুনের পর বাড়াবাড়ি করলে অথবা আইনের আশ্রয় নিলে প্রাণনাশেরও হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন মুন্নী।
চন্দনাইশ থেকে ধরে নিয়ে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ : চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়ন থেকে দুই ভাইকে ধরে নিয়ে টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগে প্রদীপসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা হয় ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে। আমানুল হক ও আজাদুল হক দু্‌ই ভাই ছিলেন চন্দনাইশের ফকিরপাড়া গ্রামের আমিনুল হকের ছেলে। তাদের মধ্যে ছোট ভাই আজাদ প্রবাসী। বড় ভাই আমানুল হকের মোবাইল মেরামতের দোকান থাকলেও পরে তিনি পেয়ারা চাষ করতেন।
আজাদ বিদেশ থেকে এসেছে জানতে পেরে চাঁদার জন্য টেকনাফ থানার পুলিশ চন্দনাইশ থানার পুলিশের সহায়তায় তাদের বাড়ি থেকে ধরে নেয় বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়। এক্ষেত্রে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে আট লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে দুই ভাইকে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে।
ওই বছরের ১৩ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমানুলকে এবং ১৫ জুলাই বেলা ২টার দিকে আজাদকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে স্বজনদের দাবি। তবে পুলিশ বলেছিল, তাদের ধরা হয়েছে টেকনাফ থেকে। ১৬ জুলাই কঙবাজার সরকারি হাসপাতালে দুই ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা।
ঘরে আগুন, ধরে নিয়ে হত্যা : মিথ্যা মামলার প্রতিবাদ করায় ২০২০ সালের ২৮ মার্চ টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাইঙ্গাঘোনার মুছা আকবর নামে এক ব্যক্তিকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার মামলা রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে।
২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুছার বড় ভাই আলী আকবরের বাড়িতে ‘অগ্নিসংযোগ করে’ পুলিশ। সেদিন বাদীর বৃদ্ধ শ্বশুর আবুল বশর ও ভাবি আরিফা বেগমকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে একটি মামলায় এই দুজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ওই ঘটনায় পরে ৫ মার্চ কঙবাজার প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন মুছা আকবর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২৮ মার্চ দুপুরে মুছাকে ধরে নিয়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন প্রদীপসহ পুলিশ সদস্যরা। পরে ৩ লাখ টাকা দেওয়া হলেও রাতে বন্দুকযুদ্ধের নামে মুছাকে হত্যা করা হয় বলে এজাহারে বলা হয়। ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করা এ মামলার ২৭ আসামির মধ্যে প্রদীপসহ ২২ জন পুলিশ সদস্য।
পল্লীবিদ্যুৎ অফিস থেকে তুলে নিয়ে হত্যা : ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের আদালতে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগে আরও দুটি মামলা হয় প্রদীপের বিরুদ্ধে। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজির পাড়ার নুর আহম্মদ নিহতের ঘটনায় তার স্ত্রী লাইলা বেগম একটি এবং একই ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার মোহাম্মদ আজিজ নিহতের ঘটনায় তার মা হালিমা খাতুন আরেকটি মামলা করেন।
লাইলা বেগমের অভিযোগ, ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ সকালে স্থানীয় মোহাম্মদ কালু নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে নুর আহমদ টেকনাফ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে যান। এর ঘণ্টাখানেক পর সেখান থেকে এক দল পুলিশ তাকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। পরে খবর শুনে স্বজনরা থানায় যোগাযোগ করলে নুর আহমদ ছেড়ে দিতে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
পাঁচ লাখ টাকা ওসি প্রদীপের হাতে দিলেও বাকি টাকা না দেওয়ায় ২১ মার্চ রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ সদর ইউনিয়নের রাজারছড়া এলাকায় নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে নুর আহমদকে হত্যা করা হয় বলে লাইলার অভিযোগ। এই মামলায় প্রদীপসহ ১৫ পুলিশে সদস্য আসামি।
চাঁদার অর্ধেক পেয়ে এক ভাইকে হত্যা : প্রদীপসহ টেকনাফ থানা ও হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ২৭ পুলিশ সদস্যসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার নিহত সাদ্দাম হোসেনের মা গুল চেহেরা মামলা করেন ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট। এজাহারে বলা হয়, ২০২০ সালের ৪ জুলাই গুল চেহেরার ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও মো. জাহেদ হোসেনকে বাড়ি থেকে আটকের পর তাদের ছেড়ে দিতে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে পুলিশ। জমি ও স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে পুলিশকে পাঁচ লাখ টাকা দিলে জাহেদকে এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুদিন পর ৬ জুলাই আদালতে পাঠানো হয়। এর একদিন পর ৭ জুলাই হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কম্বোনিয়া বড়ছড়া এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সাদ্দাম হোসেন। একইসঙ্গে আব্দুল জলিল নামে আরেক ব্যক্তিও নিহত হন।
১০ দিন আটকে রাখার পর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ : ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের উত্তর শিলখালী এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন আব্দুল আমিন নামের এক ব্যক্তি। নিহতের ভাই নুরুল আমিনের দাবি, সুপারি ও মাছের ব্যবসা করে আসা তার ভাইয়ের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল পুলিশ। চাঁদা না দেওয়ায় আমিনকে ২১ সেপ্টেম্বর সকালে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ১০ দিন থানায় আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।
পুলিশকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হলেও বাকি টাকা না দেওয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে আমিনকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয় বলে তার স্বজনদের অভিযোগ। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নুরুল আমিন আদালতে হত্যা মামলা করেন ৩০ পুলিশ সদস্যসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে।
চাঁদা না দেওয়ায় হত্যা : ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করা হত্যা মামলায় হাফেজ আহমদ নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল তার ভাই সাহাব উদ্দীনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তার পরিবার থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। স্বজনরা ৫০ হাজার টাকা দিলেও বাকি টাকা না দেওয়ায় পরের রাতে বন্দুকযুদ্ধের নামে সাহাবকে হত্যা করা হয় বলে তার ভাইয়ের অভিযোগ। তার মামলায় প্রদীপসহ ২৫ পুলিশ সদস্য আসামি।
বিদেশ ফেরতের কাছে টাকা না পেয়ে হত্যা : ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট কঙবাজারের আদালতে মাহমুদুল হক নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে মামলা করেন তার ভাই নুরুল হোছাইন। এই মামলায় প্রদীপসহ ১৬ পুলিশ আসামি।
হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার মিয়া হোসেনের ছেলে মাহামুদুল বিদেশ থেকে ফেরার পর প্রদীপ তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে মামলায় অভিযোগ। ওই টাকা না দেওয়ায় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ৫ লাখ টাকা দিলেও দুদিন পর ৩১ মার্চ তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ নুরুলের।
চাঁদা না পেয়ে দিনমজুরকেও হত্যা : ৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় দিনমজুর মোহাম্মদ আজিজকে হত্যা করা হয় বলে তার মা হালিমা খাতুনের অভিযোগ। তিনি মামলায় ওসি প্রদীপসহ ১৪ পুলিশকে আসামি করেছেন। হালিমার অভিযোগ, ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে তার ছেলে আজিজসহ স্থানীয় বাসিন্দা নুর হাছান ও আবদুল খায়েরকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। পরে পুলিশ আজিজকে ছেড়ে দিতে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হলেও বাকি টাকা না পেয়ে ১৯ মার্চ রাতে আজিজকে মহেশখালিয়া পাড়ার নৌকাঘাটে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের ‘নাটক সাজিয়ে’ হত্যা করা হয় বলে এই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
৬ লাখ টাকা দিয়েও বাঁচেননি ডিলার : ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রাতে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পূর্ব মহেশখালিয়া পাড়ায় পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে সরকারি সার ও চালের ডিলার মফিদ আলম। তার ভাই মো. সেলিমের অভিযোগ, ১৫ লাখ টাকা চাঁদা না দিলে মফিদকে ‘ক্রসফায়ারের’ হুমকি দেয় পুলিশ। ২০১৯ সালের ১১ জুলাই সন্ধ্যায় তাকে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তখন ৬ লাখ টাকা পুলিশকে দিলেও তাকে ছেড়ে দেয়নি। তিন দিন পর ১৪ জুলাই রাতে পাহাড়ি এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে মফিদের মৃত্যুর খবর পায় স্বজনরা। এই হত্যা মামলায় মফিদের ভাই সেলিম ওসি প্রদীপসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে আসামি করেছেন।

২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কঙবাজারের আদালতে স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান নির্যাতনের অভিযোগে প্রদীপসহ ২৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ফরিদ অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জনতার বাণী ডটকম’ ও ‘দৈনিক কঙবাজার বাণীর’ সম্পাদক ও প্রকাশক।
প্রদীপ যখন ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানার এসআই, তখনও অপকর্মে ছিলেন তিনি। পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছিলেন তিনি। পরে তাকে কঙবাজার জেলায় পাঠানো হয়।
তখন কঙবাজার সদর থানায়ও একটি জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে প্রদীপের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। ওই মামলার কারণে তার পদোন্নতিতে জটিলতা দেখা দেয়। ২০০৯ সালের শেষ দিকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১০ সালে আবার প্রদীপের পদায়ন হয় সিএমপিতে। ২০১১ সালে দায়িত্ব পান সিএমপির পতেঙ্গা থানার ওসির।
২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানার ওসি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়কে ঘিরে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা প্রতিরোধে ভূমিকার জন্য পুলিশ মহলে প্রশংসার মধ্যে হত্যা মামলার এক আসামির আইনজীবীকে আটক করে সমালোচনায় পড়েন। প্রদীপসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা সেই আইনজীবী নুরুল আলম বলেন, তখন ওসি প্রদীপ দাশের নেতৃত্বে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছিল পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।
বোনের জমি দখল, রিফাইনারির লরি আটক : পাঁচলাইশ থানা থেকে ওসি প্রদীপ বদলি হন শাহ আমানত বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশে। সেখান থেকে পরে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি হন। তখনই বোনের জায়গা দখল করে পুনরায় সমালোচনায় পড়েন প্রদীপ।
প্রদীপের ভাগ্নে সুমন চৌধুরী জানান, মুরাদপুর এলাকায় তার মায়ের সূত্রে পাওয়া ৩২ শতাংশ জায়গা অর্পিত সম্পত্তি আইনে চলে গিয়েছিল। তখন মামা প্রদীপকে জায়গাগুলো উদ্ধার করে দিতে বলেছিলেন তারা। কিন্তু তিনি উদ্ধার করে না দিয়ে তাকে জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে প্রদীপ নিজে ২৪ শতাংশ এবং অন্য এক ব্যক্তির মাধ্যমে আরও ৬ শতাংশ জমি দখল করেন বলে অভিযোগ সুমনের। তার অভিযোগ, জমি আত্মসাতের জন্য প্রদীপ এক নারীকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করিয়েছেন। ওই মামলায় তাকে ১৬ দিন কারাবাস করতে হয়।
বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ওসি থাকাকালে একটি রিফাইনারির তেল আটক করে বরখাস্ত হন প্রদীপ। পরে পুলিশের সিলেট রেঞ্জে বদলি হন পরিদর্শক প্রদীপ। তবে কিছুদিনের মধ্যে আবার চট্টগ্রামে ফিরে ২০১৬ সালে ফের যান কঙবাজারে, মহেশখালীর ওসি হয়ে।
স্ত্রীর নামেও অবৈধ সম্পদ : সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর তার নানা অপকর্ম বেরিয়ে এলে ওসি প্রদীপের সম্পদের খোঁজে নামে দুদক। ২৩ আগস্ট দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন মামলা করেন প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ২৮ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্রও জমা পড়ে। অভিযোগপত্রে ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৭ টাকা সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া এবং ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ’ অর্জন ও অন্যকে হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয় প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
অভিযোগপত্রে যেসব সম্পদের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো নগরীর পাথরঘাটায় একটি ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরে সেমিপাকা ঘর, ৪৫ ভরি সোনার গয়না, একটি করে কার ও মাইক্রোবাস এবং কঙবাজারে ফ্ল্যাট। প্রদীপ কারাগারে থাকলেও তার স্ত্রী চুমকি এখনও পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরায়ে সন্তুষ্ট নন প্রদীপের আইনজীবী
পরবর্তী নিবন্ধসরকারি জ্বালানি তেল পরিবহনে মানা হয়নি প্রচলিত আইন