একশ দিনের মধ্যে শহরের বিরাট পরিবর্তন আশা করা ভুল হবে বলে মন্তব্য করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রায় এক হাজার কোটি টাকার দেনা ও নানাবিধ সমস্যা মাথায় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। দায়িত্ব গ্রহণের পর একশ দিনের সময়সীমার মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনায় ক্রাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে ৯০ শতাংশ সাফল্য এসেছে। তবে মশক নিধনে পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। সড়ক সংস্কার কাজের সিংহভাগ সাফল্য এসেছে।
দায়িত্ব গ্রহণের পরবর্তী ১০০ দিনের ক্রাশ প্রোগ্রামের অগ্রগতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন মেয়র। গতকাল সকালে আন্দরকিল্লাস্থ নগর ভবনে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় তিনি বলেন, ১০০ দিনে অনেক কিছুর সূচনা করেছি। সভায় মেয়র খাল-নালা পরিষ্কার ও প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে সড়ক সংস্কারের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন। তিনি খাল-নালায় পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনা ফেললে জরিমানা করা হবে বলেও ঘোষণা দেন। বিভিন্ন খালে সিডিএ মেগা প্রকল্পের আওতায় দেয়া বাঁধ দ্রুত অপসারণের আহ্বান জানান মেয়র। অন্যথায় বর্ষায় নগরে গলা পানি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সমন্বয়ে গুরুত্ব : সমন্বয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে মেয়র বলেন, অনেক কাজ আমরা সুন্দরভাবে করলেও সমন্বয়ের অভাবে বিলীন হয়ে যায়। যেমন স্ট্র্যান্ড রোডে আমরা কাজ করার পর ওয়াসার পাইপলাইনের জন্য নষ্ট হয়েছে। তাই সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সমন্বয় ছাড়া করলে শহরকে সুন্দরভাবে সাজানো যাবে না। সমন্বয়ে সিটি মেয়রের অবিভাবকত্ব থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব না থাকলে শহর সুন্দরভাবে গড়া যাবে না। যত সেবা সংস্থা আছে তারা কাজ করার সময় সিটি কর্পোরেশন ও মেয়রকে অবহিত করে করতে হবে। সিডিএর মেগা প্রকল্পে কাউন্সিলরদের সাথে সমন্বয় করতে বলেছি। সিটি কর্পোরেশনকে অবিহিত করে করলে সেখানে যে অসঙ্গতি আছে সেটা দূর হবে। সমন্বয়ের জন্য ৪৪ মাস পর টাস্কফোর্সের সভা করেছি। অর্থাৎ আমি চাচ্ছি সমন্বয় নিশ্চিত করতে । তিনি বলেন, শহরকে রক্ষা করতে হলে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। শহরের স্বার্থে আমি সবার পরামর্শ গ্রহণ করব। আমার মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা নেই। ইগোর সমস্যা নেই। কারো কাছে গেলে শহরের উন্নয়ন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যাব। আমার ভুল-ত্রুটি হতে পারে। নিজের ভুল নিজে দেখে না। সেটা আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে। কেউ দেখিয়ে দিলে শুধরে চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিতে কাজ করব।
তিনি বলেন, ফুটপাত, খাল-নালার উপর দোকান হচ্ছে। অনেক প্রভাবশালী প্রভাব দেখায়। কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি, যত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হোক কোনো অবস্থায় ছাড় দিব না। এসময় আর.এস সিট অনুযায়ী খাল-নালা উদ্ধার করতে হবে উল্লেখ করে বলেন, অনেক খাল-নালা দখল করে সংকুচিত করা হয়েছে। ভরাট করা হয়েছে। ভবনের বাউন্ডারি ওয়াল দেয়া হয়েছে খাল-নালায়। এরপরও সবাই নিরব-নিশ্চুপ। তিনি বলেন, আমি কাউকে নগরীর কোনো ফুটপাত বা জায়গা ইজারা দিইনি। কাউকে কোনো বিলবোর্ড লাগানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলে আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা : তিনি বলেন, গত একশ দিনে কোথাও স্থানে আবর্জনার স্তূপ ছিল না এবং জমে থাকা আবর্জনা দ্রুত ডাম্পিং করা হয়। ৪১টি ওয়ার্ড থেকে ২ হাজার ১২০ ট্রিপের মাধ্যমে ১০ হাজার ৬০০টন আবর্জনা ডাম্পিং করা হয়। ৫০ টি ছোট-বড় খাল থেকে জমাট আবর্জনা অপসারণ ও ভরাট মাটি উত্তোলন করা হয়।
খাল-নালায় পলিথিন ফেললে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পলিথিন নিয়ে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। পলিথিন বন্ধ করতে না পারলে কর্ণফুলী বুড়িগঙ্গা হয়ে যাবে, মরে যাবে। এসময় শহর রক্ষায় পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে মন্তব্য করে বলেন, পাহাড় কাটা, নালায় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। খালের সাথে লাগানো ভবন থেকে ময়লা সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। ফুলতলায় খাল সাতবার পরিষ্কার করেছি। কিন্তু আবারো পূর্বের অবস্থা হয়ে গেছে।
রাতে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় আপাতত রাতে আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। পরিস্থিতির উন্নতি হলে শীঘ্রই তা আবার শুরু হবে। মশক নিধন প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে ফগার স্প্রে ও হ্যান্ড স্প্রের মাধ্যমে তরল ওষুধ ছিটানো হয়েছে। নাগরিক অসচেতনতার কারণে যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা এবং সিডিএ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে খালের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দেয়ায় জমাট পানি মশক প্রজননের উৎসক্ষেত্রে পরিণত হয়। এছাড়াও ছিটানো তরল ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অপ্রতুলতায় মশক নিধনে শতভাগ সাফল্য আসেনি। মশক নিধনে ব্যবহৃত তরল ওষুধের কার্যকারিতা নিরূপনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগরে প্রফেসর ড. রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পাওয়া মাত্র প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা মেগা প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএর। এক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব শুধু নগরীর ৩ ফিটের নালাগুলো পরিষ্কার করা। এছাড়া মেগা প্রকল্পের কাজের কারণে সমস্ত বড় নালা, খালে বাঁধ রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে শেখ মুজিব রোডের বঙ কালভার্ট ও সিল্টট্রাপ নিয়ে প্রসঙ্গে বলেন, বঙ কালভার্টে একটা নেট ছিল। বর্জ্যের পরিমাণ এত বেশি নেটে এসে জমে যেত। হয়তো সেখানে মেইনটেনেন্স আমরা সঠিকভাবে করতে পারছি না। পরে জনগণ নেট খুলে ফেলে। এতে সব বর্জ্য সেখানে ঢুকে পড়ে। এটা নিয়ে কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ ও অন্যান্যদের সঙ্গে বসেছি। কিভাবে সেটা পরিষ্কার করে কার্যকর করা যায়।
গাড়ি কেনা প্রসঙ্গ : সিটি মেয়রের জন্য এক কোটি ত্রিশ লাখ টাকায় গাড়ি কেনার উদ্যোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে। তবে টেন্ডার হওয়া মানে কেনা হয়ে গেছে সেটা ঠিক না। এক বছর-দুই বছর পরেও টেন্ডার কার্যকর করা যায়। তবে কর্পোরেশনের জন্য যেটা দরকার সেটা করতে হবে। হ্যাঁ, আমি তুণমূল থেকে রাজনীতি করে আসছি। ট্যাঙি করেও যেতে পারব। এতে আমার আপত্তি নেই। তবে এটা (গড়ি) তো ব্যক্তিগত রেজাউলের না, কর্পোরেশনের সম্পত্তি। তিনি বলেন, বর্তমানে যে গাড়ি আছে সেটা এক কোটি ১০ লাখ টাকায় ২০০৬ সালে তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দন চৌধুরীর সময় কেনা। ১৬ বছর পর এসে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা, মানে ১৬ লাখ টাকা বেড়েছে। এটা বেশি বেড়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমাকে নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেয়া হলে বর্তমানটাই ব্যবহার করব বলেছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই গাড়ি নিয়ে সরাইপাড়া ও পাহাড়তলীসহ চারবার পথে আটকে গেছি। গাড়ি আর স্টার্ট হয় না। মেয়রের ব্যবহারের জন্য দ্বিতীয় কোনো গাড়িও নেই। এ গাড়ির পেছনে যথেষ্ট খরচ হচ্ছে। মেইনটেনেন্স কস্টও বেশি।
অন্যান্য : তিনি বলেন, এলইডি লাইট স্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সফল। ৩০টি রাস্তা ৭৬ কিলোমিটার অংশে ২৯৬০ পোলের সাহায্যে ৫০১১টি এলইডি লাইট স্থাপন করা হয়েছে। নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে রাস্তায় মিডিয়ান ও ফুটপাত রংকরণের ৭০ ভাগ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুতোষিকের টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না, এমন সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, এখন পর্যন্ত কর্পোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মোট ৩৩ জনকে ৬৭ লাখ ২৫ হাজার ১১০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কাজেই না জেনেই মন্তব্য করা ঠিক না। এতে আমি মর্মাহত।
পরিকল্পনা : রাজস্ব বাড়াতে আয় বর্ধক প্রকল্পে জোর দিচ্ছেন জানিয়ে বলেন, বিপুল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি থাকলেও এর গুণগত ও আয়বর্ধক ব্যবহার যথাযথভাবে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া ইজারা দেয়া হয়েছে। কার্যতঃ এতে লিজ গ্রহীতা লাভবান হলেও সিটি কর্পোরেশনের আয় বর্ধিত হয়নি। এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে তদন্ত কার্যক্রম চলছে। সিটি কর্পোরেশনের বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত নিজস্ব জায়গায় একাধিক আয়বর্ধক প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় বিনিয়োগ নীতিমালার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অর্জনের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। আয়ের উৎস অনুসন্ধানে পর্যটন খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা বীচ পর্যন্ত সিডিএ কর্তৃক নির্মাণাধীন আউটার রিং রোড সংলগ্ন ১০নং উত্তর কাট্টলী এলাকায় সমুদ্রের পাশে ১টি ওশান পাক, ১টি স্মৃতিসৌধ ও ১টি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করছি এবং পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাট ও পশুহাট উম্মুক্ত পদ্ধতিতে ইজারা প্রদানের ফলে চসিকের রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হয়েছে। লকডাউনের কারণে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও অর্থ বছরের বাকি দিনগুলোতে রাজস্ব আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন, মো. গিয়াস উদ্দীন, আফরোজা কালাম, কাউন্সিলর মো. শহীদুল আলম, মো. এসরারুল হক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চসিক সচিব খালেদ মাহামুদ, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া, মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী, উপ-সচিব আশেক রসুল চৌধুরী টিপু, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ, অতিরিক্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোর্শেদুল আলম চৌধুরীসহ চসিকের পদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।