শনিবার (গতকাল) দুপুর ১টা ২০ মিনিট। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে দুই ঘণ্টা পেরিয়েছে। অথচ তখনো চকবাজার আধুনিক চক সুপার মার্কেটের পূর্ব দিকের রাস্তায় জমে ছিল হাঁটু সমান পানি। একই সময়ে সমপরিমাণ পানি জমেছিল কাপাসাগোলা আবদুল হাকিম শাহ লেনে। বিকেল ৫টার সময়ও সরেনি লেনটির পাানি। পাশেই মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেন। সেখানে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পানি ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গতকাল ভোর রাত থেকে প্রায় সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রায় একটানা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়েছে নগরে। এরপর প্রায় ১১টা পর্যন্ত থেমে থেমে অল্প বৃষ্টি হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বেশ কিছু এলাকায়। এসময় দুই নম্বর গেইটসহ বিভিন্ন এলাকার কোথাও হাঁটু এবং কোথাও গোড়ালি সমান পানিতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।
জলাবদ্ধতা নিরসনে গত চার বছর ধরে নগরে ১০ হাজার ৯২১ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এরপরও অল্প বৃষ্টিতে কেন তীব্র জলাবদ্ধতা হচ্ছে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন পানিবন্দী থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে? জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, শহরের অনেকগুলো প্রধান খাল এখনো ভরাট হয়ে আছে। এছাড়া প্রকল্পের কাজের সুবিধার্থে কয়েকটি খালে পূর্বে দেয়া বাঁধ গতকাল বৃষ্টির সময়ও অপসারণ করা হয়নি। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন অলিগলিতে বিদ্যমান ছোট ছোট নালাগুলো ভরাট হয়ে আছে। ফলে এসব এলাকার পানি দ্রুত নামতে না পারায় জলযট সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দ্রুত খালের মাটি ও বাঁধ অপসারণ এবং অলিগলির নালা-নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় সামনে ভারী বর্ষণ হলে জলাবদ্ধতা আরো তীব্র হবে।
স্থায়ীরা জানিয়েছেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশে মাটি জমে আছে। রাজাখালী খালেও একই অবস্থা। ভরাট হয়েছে খালটি। এ খালের একটি পয়েন্টে বাঁধ আছে। বাঁধ আছে তুলাতুলী খালেও। চশমা খালেও বাঁধ ছিল। বৃষ্টির পর চশমা খাল ও তুলাতলী খালের বাঁধের একাংশ কেটে দেয়া হয় বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফিরিঙ্গি বাজার খাল, বামনশাহী খাল এবং উত্তরা খালেও মাটি জমে আছে।
জানা গেছে, নগরে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প। কারণ প্রকল্পটির আওতায় রয়েছে শহরের প্রধান খাল চাক্তাই ও মহেশখালসহ ৩৬টি খাল। অর্থাৎ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব খাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেগুলো এ প্রকল্পের অধীনে খনন ও পরিষ্কার করার কথা।
মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, পুরো শহরের অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। দুই নম্বর গেইটে একটু পানি উঠেছে। তা হতো না। আমাদের অগোচরে ঠিকাদার একটি বাঁধ দিয়েছিল। ওটার জন্যই মূলত পানি উঠে। পরে অবশ্য সেটা আমরা খুলে দেয়ার পর পানি দ্রুত নেমে যায়। চকবাজার কাপাসগোলা এলাকার জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হিজরা খাল দিয়ে ওসব এলাকার পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু জায়গা অধিগ্রহণ না হওয়ায় সেখানে আমরা কাজ শুরুই করতে পারিনি। তাই চকবাজার এলাকার সমস্যার সমাধান হতে আরো কিছুদিন লাগবে।
রাজাখালী খালের বাঁধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজাখালী খাল-১ এ বাঁধের জন্য পানি নিষ্কাশনে কোনো সমস্যা হবে না। দূর থেকে বাঁধ মনে হলেও সেখানে ছয় ফুট ডায়ামিটারের তিনটা পাইপ আছে। তাই পানি যেতে সমস্যা হবে না। রাজাখালী খাল-৩ এ রিটেইনিং ওয়ালের কাজ চলছে। তুলতলী খালে সিল্টট্রাপ নির্মাণের জন্য বাঁধ দেয়া আছে। তবে সেটা বৃষ্টি হলে একপাশে খুলে দেয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফিরিঙ্গিবাজার খালে বাঁধ ও মাটি থাকবে। তবে সেটার জন্য জলাবদ্ধতার সমস্যা হবে না। বামনশাহী খাল, টেকপাড়া খাল, উত্তরা খালেও কাজ চলমান থাকবে। এর মধ্যে টেকপাড়া খালের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন খালে মাটি অপসারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, জলাবদ্ধতা হতে পারে এমন খালে বাঁধ নাই। অন্যান্য খাল থেকে আমরা মাটি সরিয়ে নিচ্ছি। খেয়াল করলে দেখবেন, পুরো খালে মাটি নাই। একপাশে নিয়ে আসছি মাটি। অপর পাশে পানি চলাচলের ব্যবস্থা আছে। একপাশ থেকে মাটিগুলো স্কেভেটর দিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল সকালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ডিসি রোড পেরেক ফ্যাক্টরি থেকে বগার বিল বাজার পর্যন্ত এলাকায় হাঁটু সমান ছিল। শিপন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, রাস্তার পাশে নালার উন্নয়ন কাজ চলছে। এতে নালা ভরাট হয়ে থাকায় পানি যেতে পারছে না। এ ছাড়া ২ নম্বর গেট, চকবাজার, কাপাসগোলা, কালামিয়া বাজার, বাদুরতলা, জঙ্গী শাহর মাজার গেট, বড় মিয়া মসজিদ, কে বি আমান আলী রোড, ফুলতলা, হালিশহর নয়া বাজার বিশ্ব রোড মোড়, আই ব্লক, বি ব্লকের নিচু এলাকা এবং দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় গোড়ালি থেকে হাঁটু সমান পানি ছিল। গতকাল শনিবার থাকায় বন্ধ ছিল সরকারি অফিস-আদালত। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরদের অফিসে যেতে ভোগান্তি হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন।