খালের বাঁধ অপসারণ করতে হবে ১৫ দিনের মধ্যে

সাড়ে ৪৪ মাস পর টাস্কফোর্সের সভা ।। সেবা সংস্থার সমন্বয় ও পলিথিনমুক্ত শহর গড়ায় জোর

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৩১ মে, ২০২১ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে চলমান সিডিএর মেগা প্রকল্পের সুফল নিশ্চিতে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সিটি মেয়রের নেতৃত্বে প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার সমন্বয় সভা করা হবে। একইসঙ্গে নিয়মিত খাল-নালা, ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলদারদের জরিমানা করা হবে। নগরের খালসমূহের দুই পাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিংয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাড়ে ৪৪ মাস পর গতকাল রোববার সকালে টাইগারপাস অস্থায়ী নগর ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন।
সভায় নগরের বিভিন্ন খালে মেগা প্রকল্পের কাজের সুবিধার্থে যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে তা আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে অপসারণ, স্লুইচগেট নির্মাণ শেষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর, পলিথিনের জন্য খাল-নালা ও কর্ণফুলী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পলিথিনমুক্ত শহর করতে সামজিক আন্দোলন, কর্ণফুলী নদী দ্রুত ড্রেজিং করা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসাকে টাস্কফোর্সে সংযুক্ত করার বিষয়েও সবাই একমত হন। এছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণীত স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান ও ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে সিডিএর মেগা প্রকল্পের যেসব অসঙ্গতি আছে তা চিহ্নিত করে সমন্বয় করার সুপারিশ করতে একটি সাব কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শেখ মুজিব রোডের ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার বঙ কালভার্ট সিটি কর্পোরেশনকে পরিষ্কারের প্রস্তাব দেয় সিডিএ। চসিক তাতে সম্মতি দেয়। সভার সিদ্ধান্ত ও আলোচনা প্রসঙ্গে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সবাই সমন্বয় নিশ্চিতে একমত হয়েছেন। সবাই বলেছেন, সিটি কর্পোরেশন তথা মেয়র নেতৃত্ব দিলে অনেক এগিয়ে যাবে। মেগা প্রকল্পে সমন্বয় করলে সুফল পাবে জনগণ। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, পলিথিনে খাল-নালা দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাই পলিথিনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার রোধে নিয়মিত অভিযান চালাব। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদেও কঠোর হব। অভিযান চলবে। এক্ষেত্রে সিএমপি আমাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
এদিকে সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে খালের বাঁধ কেটে দিতে হবে। দ্রুত খাল খনন শুরু করতে হবে। অন্যথায় ভারী বৃষ্টি হলেই শহর ডুবে যাবে। তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে শহরের খালগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও দখল হওয়া খালের পুনরুদ্ধারে জোর দেন।
তিনি বলেন, নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। যদি প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর একটি সদিচ্ছার অপমৃত্যু হবে এবং টাকারও অপচয় হবে। তাই এই টাস্কফোর্স কমিটি এখন থেকে অন্তত দুই মাস পর সভায় মিলিত হতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিং করার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে।
মেয়র বলেন, সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব স্লুইচগেট নির্মাণ করছে তা সম্পন্ন হলে পরিচালনার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া হলে তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তা পরিচালনা সম্ভব হবে।
সভায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সিডিএর মেগা প্রকল্পের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণীত স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান ও ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে ৫৭টি খাল আছে। তবে মাস্টার প্ল্যানটির উপর ভিত্তি করে সিডিএর গৃহীত মেগা প্রকল্পে ৩৬টি খাল আছে। বাকি ২১ খালকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাস্টার প্ল্যানে রেগুলার ড্রাই ক্লিনিং আছে ৫০০ কিলোমিটার। কিন্তু মেগা প্রকল্পে আছে ৩০২ কিলোমিটার। বাকি ১৯৮ কিলোমিটার সংযুক্ত করতে হবে। ওয়াসার মাস্টার প্ল্যানে ১০০ কিলোমিটার ‘নতুন সাইড ড্রেন’ নির্মাণের প্রস্তাবনা থাকলেও সিডিএর প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করার কথা রয়েছে ১০ কিলোমিটার। বাকি ৯০ কিলোমিটার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাস্টার প্ল্যানে ৩৯ কিলোমিটার কাঁচা ড্রেনকে পাকাকরণের সুপারিশ আছে। কিন্তু সিডিএ তা সংযুক্ত করেনি। মাস্টার প্ল্যানে ১০ হাজার স্কয়ার মিটার ড্রেন স্ল্যাব নির্মাণের সুপারিশ আছে। সেটাও সংযুক্ত করেনি মেগা প্রকল্পে। নিচু এলাকায় পানি নিষ্কাশনে ৪১টি সারফেস পাম্প বসানোর সুপারিশ থাকলেও সিডিএ তা সংযুক্ত করেনি।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন ঢাকার চেয়েও কঠিন। আমরা ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টিতে কাজ করছি। বাকি খালগুলোতে কাজ করা উচিত। এজন্য সিটি কর্পোরেশন আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, সিডিএ ১৭টি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৩টি নির্মাণ করছে। কাজ শেষে তা সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ স্লুইচগেট পরিচালনার জন্য জনবল দরকার এবং এ জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি খালের দুই পাশে প্রশস্ত রাস্তা করার জন্য চসিককে অনুরোধ জানান।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, কর্ণফুলী নদীতে দৈনিক ২২ হাজার টন মানববর্জ্য পড়ছে। তাই এই নদীর দূষণ ঠেকানো যাবে কিনা বা আদৌ কর্ণফুলীকে বাঁচানো যাবে কিনা তা নিয়ে ভাবা উচিত। তিনি বলেন, আগ্রাবাদ বঙ কালভার্টের কারণে বন্দরের ১ নং জেটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে দুই থেকে আড়াই মিটার স্তরে পলিথিনের কারণে কর্ণফুলীতে ড্রেজিং করা যাচ্ছে না।
সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ত্রয়ন কুমার ত্রিপুরা জানান, তাদের একটি প্রকল্পের আওতায় কালুরঘাট সেতু থেকে কাটাখালী মুখ পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার ফ্ল্যাড ওয়াল করছে। এক্ষেত্রে সিটি মেয়র যতটুকু সম্ভব পাশে রাস্তা করার পরামর্শ দেন। মেয়র বলেন, রাস্তা হলে মদুনাঘাট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত নদীর পার দিয়ে যাতায়াত সুবিধা বাড়বে।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সকল সংস্থার সমন্বয় সাধন জরুরি। সেক্ষেত্রে চসিক মেয়রকে অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে। অবৈধ উচ্ছেদের ব্যাপারে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করব।
চসিক প্যানেল মেয়র মো. গিয়াস উদ্দীন বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্পে চসিকের সাথে সমন্বয় করা হয় না। কাউন্সিলর মো. মোরশেদ বলেন, মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করা হয়নি বলে খালের উপর ভবন তৈরি হয়েছে। কর্ণফুলী ড্রেজিং না করলে মেগা প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না। কাউন্সিলর শহীদুল আলম বলেন, বাকলিয়া নিম্নাঞ্চল বলে নগরীর সমস্ত পানি চাক্তাই খাল, মির্জা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেক্ষেত্রে খাল খনন ছাড়া পানি প্রবাহ সঠিকভাবে হতে পারবে না।
কমিটির সদস্য সচিব ও চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঞ্চালনায় সভায় কাউন্সিলর এম আশরাফুল আলম, মো. মোরশেদ আলম, মোহাম্মদ শহীদুল আলম, হাজী নুরুল হক, মো. আব্দুল মান্নান, চসিক সচিব খালেদ মাহামুদ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. নুরুল্লাহ নুরী, জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি মামুনুল আহমেদ অনিক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অয়ন কুমার ত্রিপুরা, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক নিউটন দাশ বক্তব্য রাখেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১২ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর টাস্কফোর্সের প্রথম সভা হয়েছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজ ভবিষ্যৎ গড়তে ঐক্যের আহ্বান শেখ হাসিনার
পরবর্তী নিবন্ধচাকরির প্রলোভনে পতিতাবৃত্তি, দুই কিশোরী উদ্ধার