ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রথম পর্যায়ে ২৩৭ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার পুরনো আসন বগুড়া–৭ ও ফেনী–১ এর সঙ্গে প্রথমবারের মতো দিনাজপুর–৩ আসনে নির্বাচন করবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রথমবার ভোট করবেন বগুড়া–৬ আসন থেকে। আর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও–১ আসন থেকে প্রার্থী হবেন।
গতকাল সোমবার বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম পড়ে শোনান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আজকে ২৩৭ আসনে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলাম। এরপরে আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন সেই সমস্ত দলের সাথে কথা বলে যে সমস্ত আসন আমরা ঘোষণা করিনি, তারা আসতে পারেন। অথবা আমাদের আসনও পরিবর্তন করতে পারি, এটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা বলতে চাই, এটা আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা। খবর বিডিনিউজের।
২৩৭টি আসনের মধ্যে কেবল খালেদা জিয়াই একাধিক আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তার তিনটিসহ মোট ১২টি আসনে ১০ জন নারী বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এবারই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশ ছাড়ার পর গত ১৭ বছর ধরে তিনি বসবাস করছেন লন্ডনে। নভেম্বরেই তার দেশে ফেরার কথা বিএনপি নেতারা বলে এলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি। তিন দফা সরকারে থাকা বিএনপি ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে পেয়েছিল ৩০টি আসন। সেই নির্বাচনে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ পরের তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জিতে একটানা ক্ষমতায় ছিল। এর মধ্যে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোট করে মাত্র পাঁচটি আসন পায় বিএনপি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ এবার ভোটের মাঠে নেই। সে কারণে আগামী নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখছে বিএনপি।
প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে বেলা ১২টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসে। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি বৈঠকে যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি
চার মাস আগে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এরপর ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এলডিপি এবং সর্বশেষ লেবার পার্টি আলাদা আলাদাভাবে প্রার্থী তালিকা দেয়।
বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে এবার জন্মস্থানে ভোট করবেন খালেদা : ফেনী–১, বগুড়া–৭ ও দিনাজপুর–৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে প্রার্থী হতে পারেন। এর আগে বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে নির্বাচন করেছেন; কখনো হারেননি। খালেদা জিয়ার পৈত্রিক আদি নিবাস ফেনীতে। আর তার স্বামী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৈত্রিক বাড়ি বগুড়ায়।
খালেদা জিয়ার জন্ম, শৈশব ও পড়াশোনা দিনাজপুর শহরে হলেও এর আগে তিনি কখনো এখান থেকে প্রার্থী হননি। দিনাজপুর–৩ আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার বড়বোন খুরশীদ জাহান হক প্রার্থী হন। বগুড়া–৬ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। খালেদা জিয়া সেই ১৯৯১ সাল থেকে শ্বশুরবাড়ি বগুড়ার দুটি আসনে নির্বাচন করে আসছেন। বগুড়া–৬ (সদর) এবং বগুড়া–৭ (গাবতলী ও শাহজাহানপুর) আসনে তিনি কখনো পরাজয়ের মুখ দেখেননি।
বগুড়া–৭ : বগুড়া–৭ সংসদীয় আসনের বিগত ১২টি নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি ছয়বার (এর মধ্যে খালেদা জিয়া পাঁচবার), জাতীয় পার্টি তিনবার, আওয়ামী লীগ দুবার এবং স্বতস্ত্র (বিএনপির সমর্থনে) প্রার্থী একবার জয় পেয়েছেন। খালেদা জিয়া চারবার বগুড়া–৬ আসন নিজের হাতে রেখে বগুড়া–৭ আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন। বগুড়া–৭ আসনে চারবারের মধ্যে একবার (২০০৮ সালের) উপ–নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন মওদুদ আহমদ। বাকি তিনবার (১৯৯১, ১৯৯৬–জুন এবং ২০০১ সালের) জয়ী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু।
এবার বগুড়া–৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে খালেদার ছেলে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
ফেনী–১ : ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা নিয়ে গঠিত ফেনী–১ আসন। ১৯৭৩ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ৫০ বছরের নির্বাচনে বেশিরভাগ সময় বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ফেনী জেলায় খালেদা জিয়ার আদি পৈত্রিক নিবাস। ফলে নির্বাচন এলেই এখানে স্লোগান উঠে ‘ফেনীর মেয়ে খালেদা, গর্ব মোদের আলাদা’।
১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ–নির্বাচনে বিজয়ী হন তার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার। ২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালের দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়া এখানে প্রার্থী হতে পারেননি। তখন প্রার্থী হয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম মজনু।
দিনাজপুর–৩ : আসনটি সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত। ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে বিএনপি ১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয়লাভ করে। ১৯৭৯ সালে প্রথমবার বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরী জয়লাভ করেন। পরের দুবার জয় পান খুরশীদ জাহান হক।
মায়ের পুরনো আসনে তারেকের প্রথম নির্বাচন : প্রায় দুই দশক ধরে দল ও নির্বাচন পরিচালনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তিনি কখনো সরাসরি ভোটের মাঠে প্রার্থী হননি। এবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২০২৬ সালের অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি যে প্রার্থী হচ্ছেন, তার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন। এবার তারেক রহমান বগুড়া–৬ (সদর) আসন থেকে প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা করা হয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেই ১৯৯১ সাল থেকে বগুড়া–৭ (গাবতলী ও শাহজাহানপুর) এবং ১৯৯৬ (জুন) সাল থেকে বগুড়া–৬ (সদর) আসনে নির্বাচন করছেন। এ দুটি আসনে তিনি কখনো পরাজয়ের মুখ দেখেননি। এর আগে ১৯৭৯ সালে এই আসন থেকে বিএনপির ওয়াজেদ হোসেন তরফদার, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) সালে মজিবর রহমান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে (জুন) সপ্তম সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া এই আসন থেকে নির্বাচিত হলেও পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দেন। তখন উপ–নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির জহুরুল ইসলাম।
২০০১ ও ২০০৮ সালেও খালেদা জিয়া এই আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের উপ–নির্বাচনে এই আসন থেকে জয় পান ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার।
ঢাকায় ৭ আসনে প্রার্থী বদল, ছয়টিতে পুরনো মুখ : ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি, যার মধ্যে সাতটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাকি ছয়টিতে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের ওপরেই আস্থা রেখেছে দলটি।
এর মধ্যে ঢাকা–১ (দোহার–নবাবগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন খন্দকার আবু আশফাক, যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন। ঢাকা–২ (কেরানীগঞ্জ) আসনে লড়বেন আমানউল্লাহ আমান। আগের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন তার ছেলে ইরফান ইবনে আমান অমি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে এবারও ঢাকা–৩ (কেরানীগঞ্জ–জিনজিরা) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে। ঢাকা–৪ (যাত্রাবাড়ি) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তানভীর আহমেদ রবিন। এ আসনে গত নির্বাচনে মনোনয়ন পান সালাহউদ্দিন আহমদ। ঢাকা–৫ (ডেমরা) আসনে নতুন মুখ নেই; সেখানে এবারও লড়বেন নবী উল্লাহ নবী। কোতোয়ালী ও সূত্রাপুর নিয়ে গঠিত ঢাকা–৬ আসনে লড়বেন ইশরাক হোসেন। গতবার আসনটি গণফোরামের সুব্রত চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। ঢাকা–৮ আসনে (মতিঝিল–শাহজাহানপুর–রমনা)) প্রার্থী করা হয়েছে মির্জা আব্বাসকে। তিনি আগের নির্বাচনেও এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ঢাকা–১১ (বাড্ডা) আসন থেকে লড়বেন এম এ কাইয়ুম। আগের বার এ আসনে বিএনপি থেকে লড়াই করেন শামীম আরা বেগম। ঢাকা–১২ (তেজগাঁও) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে সাইফুল আলম নীরবকে। তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনেও এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা–১৪ (মিরপুর) আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক। এবার তার জায়গায় দেওয়া হয়েছে সানজিদা ইসলাম তুলিকে। ঢাকা–১৫ (কাফরুল) আসনে লড়বেন শফিকুল ইসলাম খান। এ আসনে আগের নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন মো. শফিকুর রহমান। আমিনুল হক লড়বেন ঢাকা–১৬ (পল্লবী) আসন থেকে। এ আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মো: আহসান উল্লাহ হাসান। ঢাকা–১৯ (সাভার) আসনে গেল নির্বাচনের মতো এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন দেওয়ান সালাহ উদ্দিন বাবু।
        











