খালি পা ও টিশার্টের লেখায় খুনি শনাক্ত

প্রতিবন্ধী রিকশা চালক খুনের রহস্য উন্মোচন, গ্রেপ্তার ২

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

তারা দুজন পরিবহন শ্রমিক। সামান্য কিছু টাকার জন্য খুন করে এক প্রতিবন্ধী ব্যাটারি রিকশা চালককে। ক্লুলেস ঘটনাটির রহস্য অবশেষে উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম। গ্রেপ্তার করে ব্যাটারি রিকশা চালক মো. হাসান হত্যায় জড়িত মো. আলাউদ্দিন
(২৮) ও মো. শাকিল আহমদকে (১৯)। গত শনিবার নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন লালদিঘির পাড় সংলগ্ন গণশৌচাগারের পাশ থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। খালি পা আর টিশার্টের লেখা ‘এভরিডে’ থেকেই শনাক্ত করা হয়েছে দুজনকে।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ঘটনাটি একেবারেই ক্লুলেস ছিল। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ও সিসি ক্যামেরার ৫ম পৃষ্ঠার ১ম কলাম
ফুটেজের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করি। এরপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন। আলাউদ্দিনের বাড়ি আদর্শপাড়া এলাকায়, যেখান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার থেকে আনুমানিক ২০০ গজ দূরে। শাকিলের বাড়ি কুমিল্লায়। আলাউদ্দিন গাড়ি চালাতে পারে। শাকিল লালদিঘির পাড়ের মাইক্রো স্ট্যান্ডে গাড়ি পরিষ্কার করে। তবে সে গাড়ি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ খুঁজছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আলাউদ্দিন জানিয়েছে, আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য কার্ড বানাতে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দরকার হয় তার। টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিল সে। এ সময় পরিচয় হয় শাকিলের সাথে। হেলপার হিসেবে কাজ করার জন্য শাকিলের শিক্ষানবিশ চালক সনদের প্রয়োজন। এজন্য তারও টাকার দরকার। তারা দুজন পরিকল্পনা করে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক ব্যাটারি রিকশা চালককে টার্গেট করে। সিনেমা প্যালেসের মোড় থেকে ৩০০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে তারা যায় আদর্শপাড়া এলাকায়।
পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, আদর্শপাড়ায় গিয়ে রিকশা থামিয়ে হাসানকে চলে যেতে বলে দুজন। তখন হাসান বুঝতে পারেন যে, তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তিনি রিকশায় থাকা একটি কাঠের টুকরা দিয়ে শাকিলকে আঘাত করেন। ডান হাত না থাকায় একটি বেল্টের সঙ্গে রিকশার হ্যান্ডল বেঁধে ওই হাতের দিকে জোর এনে চালাতেন হাসান। কাঠ দিয়ে আঘাতের পর শাকিল ও আলাউদ্দিন মিলে সেই বেল্ট খুলে তার বাম হাত পেছন দিকে নিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে। এরপর লাশ ডোবায় ফেলে বেতপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। রিকশা নিয়ে আলাউদ্দিন ও শাকিল ক্রসিং পার হয়ে আনোয়ারার রাস্তা দিয়ে ফকিরনীর হাট এলাকায় যায়। সেখানে একজন ব্যক্তির কাছে আলাউদ্দিন আগেও ছিনতাই করা রিকশা বিক্রি করেছিল। ভোরে সেই ব্যক্তির কাছে এই রিকশা নিয়ে গেলে তিনি তাদের লাঠি নিয়ে তাড়া দেন। কারণ আগে কেনা রিকশার জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। তাড়া খেয়ে সেখানে রিকশা ফেলে দুজন সিইউএফএল ঘাট হয়ে ১৫ নম্বর ঘাটে ওঠে। তাদের কাছ থেকে মোবাইল সেটটি উদ্ধার করা হয়েছে। রিকশাটিও উদ্ধার করা হয়েছে।
অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানার পরপরই ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই। লাশের ছবি এবং ঘটনাস্থলের অদূরের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পিবিআই দেখতে পায়, লাশ উদ্ধারের দুদিন আগে ৭ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে লাশ উদ্ধারের ঘটনাস্থল আদর্শপাড়ার সড়ক দিয়ে দুটি সিএনজি টেঙি ঢোকে এবং বের হয়। একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা ঢুকলেও বের হওয়ার দৃশ্য ফুটেজে নেই। আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ওই রিকশাচালকের ডান হাত নেই। তখন পিবিআই নিশ্চিত হয়, নিহত ব্যক্তিটিই রিকশাচালক।
পরিচয় শনাক্তের প্রক্রিয়া চলাকালীন পিবিআই মেট্রো পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক মৃত ব্যক্তির ছবি দেখে তাকে চিনতে পারেন। মৃত ব্যক্তি মো. হাসান (৪৫) নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার বাসিন্দা। বাকলিয়া থানার রাজাখালী এলাকায় মাস্টার কলোনিতে তার বাসা ছিল। বাড়িতে তার স্ত্রী ও চার ছেলে আছে।
পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, হাসানের বাড়ি আর আমার বাড়ি এক কিলোমিটারের মধ্যে। চার বছর আগে তার ডান হাতে একটি টিউমার হয়। পরে সেটা ক্যান্সারে পরিণত হয়। তখন হাসপাতালে তার ডান হাত কেটে ফেলা হয়। এক হাত নিয়ে সে গ্রামে গিয়ে এলাকায় নানা বিষয়ে মাইকিং করাকে পেশা হিসেবে নেয়। কিন্তু উপার্জন ভালো না হওয়ায় পরের বছর সে চট্টগ্রাম শহরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে কিছু টাকা এনেছিল। প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমিও কিছু আর্থিক সহযোগিতা করে তাকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দিই।
তিনি বলেন, রাজাখালী এলাকায় একটি রিকশা গ্যারেজের মালিক জামাল মিস্ত্রি আমাদের গ্রামের বাসিন্দা। যেহেতু তার ডান হাত নেই, জামাল মিস্ত্রি তাকে একটি বিশেষ রিকশা তৈরি করে দেন, যেটার গিয়ার বাম দিকে। জামাল মিস্ত্রির বাসায় হাসান ভাত খেত ও পাশের একটি কক্ষে থাকত। ৩ নভেম্বর তিনি ব্যক্তিগত একটা কাজে আমার অফিসে এসেছিলেন। এরপর ৮ নভেম্বর গ্রাম থেকে তার ভাতিজা আমাকে ফোন করে জানায়, হাসানকে পাওয়া যাচ্ছে না, মোবাইলও বন্ধ। আমি তাকে দিয়ে প্রথমে বাকলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করাই। পরদিন অফিসে গিয়ে লাশের ছবি দেখে হাসানকে শনাক্ত করি।
লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর জড়িতদের ধরতে একাধিক টিম গঠন করেন পিবিআই মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। হাসানের খোয়া যাওয়া মোবাইলের অবস্থান এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাইয়ের দায়িত্ব পড়ে পিবিআই পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিনের ওপর। তিনিই হত্যাকাণ্ডে দুজন জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে একপর্যায়ে তাদের অবয়ব শনাক্ত করেন।
পিবিআই পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, আমরা মোট ৪৮টি পয়েন্টের শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। আদর্শপাড়ার যে স্থান থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে সেখানকার ৭ নভেম্বর রাতের ফুটেজে দেখা গেছে, ডান হাতবিহীন চালকের রিকশায় দুজন যাত্রী। তবে তাদের ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে হাসানের মোবাইলের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। ৭ নভেম্বর রাত থেকে নগরীর লালদিঘির পাড়, কোতোয়ালী, শাহ আমানত সেতু, আদর্শপাড়া, ফকিরনীর হাট, সিইউএফএল ঘাট হয়ে কর্ণফুলী নদীর শহরের অংশে পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট এবং আবার লালদিঘির পাড়ে মোবাইলটির লোকেশন পাওয়া যায়।
পিবিআই সূত্র মতে, মোবাইলের অবস্থানের ভিত্তিতে প্রত্যেকটি স্পটের ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা যায়, নগরীর সিনেমা প্যালেসের মোড়ে টেকনাফ বাস কাউন্টারের সামনে রিকশা চালক হাসান। একই রাতে আবার রিকশাসহ তার অবস্থান শনাক্ত হয় আদর্শপাড়া এলাকায়। ওই রিকশার দুই যাত্রীকে মোবাইলে যেসব স্পট শনাক্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রায় প্রতিটিতে দেখা যায়। তবে পুরোপুরি অবয়ব শনাক্ত হয়েছে পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। যাত্রী আলাউদ্দিনের পায়ে জুতা ছিল না। শাওনের গেঞ্জিতে লেখা ছিল ইংরেজিতে, এভরিডে। কয়েকটি স্পটের ফুটেজে এই দুটি চিত্র পাওয়া যায়। সেটিকেই আমরা সূত্র হিসেবে ধরে এগিয়ে যাই। ১৫ নম্বর ঘাটের ফুটেজে এই দুজনের চেহারা পুরোপুরি শনাক্ত করি। যেহেতু মোবাইলের সর্বশেষ অবস্থান লালদিঘির পাড়, আমরা শনিবার রাতে ওই এলাকায় অবস্থান নেই। একজনকে গণশৌচাগারের প্রবেশ পথে একটি চৌকিতে শোয়া ও আরেকজনকে সেখানে বসা অবস্থায় পাওয়া যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচালককে মারধর, বন্ধ অ্যাম্বুল্যান্স চলাচল
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে ছুরিকাঘাতে যুবক নিহত