খন রঞ্জন রায় বিদগ্ধ একজন লেখক। মূলত প্রাবন্ধিক। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করে সাজিয়ে কর্মনির্ভর করে তোলার প্রস্তাবক–নির্ভীক, নিরলস আদর্শের কর্মী খন রঞ্জন রায় গত ত্রিশ বছর ধরে এই ভাবনা নিয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কলাম লিখে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতির স্বরূপ সন্ধান করে চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা প্রস্তাব, সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত এসব প্রস্তাবনার অনেকগুলি সরকার এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা নীতিগতভাবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন ইতোমধ্যে। শিক্ষা, উন্নয়ন, অর্থনীতি ও সামাজিক ভাবনা নিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২ টি। দ্বাদশ গ্রন্থটির রচনার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর লেখনীর বাঁক বদল ঘটিয়েছেন। এ গ্রন্থটি গল্প সংকলন-‘সোনার চেইন’। এ গ্রন্থের পূর্বের ১১ টি গ্রন্থ প্রবন্ধ সংকলন। ‘সোনার চেইন’–এর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে গল্পকার খন রঞ্জন রায়ের।
প্রাবন্ধিক খন রঞ্জন রায়ের প্রবন্ধগুলি স্বভাবতই চিন্তাশীল বৈবিধ্যে পরিপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক সমাজ বাস্তবতার চিত্র তাঁর প্রবন্ধে বরাবরই লক্ষণীয়। ভাবনাগুলো কখনও কখনও আখ্যানেরও রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রবন্ধের নানা প্রসঙ্গের বর্ণনাকালে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার সময় উল্লেখিত নানা ঘটনা আগামী দিনের গল্প ও গল্পকারের আবিষ্কারের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল। তারই পূর্ণ প্রকাশ গল্প রচনা এবং অবশেষে গল্প সংগ্রহের প্রকাশ।
তবে ‘সোনার চেইন’কে গল্পগ্রন্থ না বলে আখ্যানগ্রন্থও বলা যেতে পারে। কেননা প্রতিটি রচনা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আখ্যানের ধারক। লেখকও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ভূমিকায়। পরিবর্তনের বিশাল এক ঢেউ লেখ্যগুণকে উথালপাথাল করে দেয়। স্বপ্নের ভেতরে হেঁটে বেড়ায় গল্পের কয়েকটি কাহিনী নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি ঘটনাকে মনের আয়নায় দাঁড় করাই। কয়েকটিকে একটিতে পরিণত করতে কিছুটা বেগ পাই। শুরু করি সীমিত বর্ণনার পঙ্ক্তি নির্মাণ। গল্পের চিত্রকল্প–উপমা–উপস্থাপনায় যেন বাক্যের সরলতা ও বক্তব্যের বলিষ্ঠতা থাকে সেইদিকে খেয়াল রাখি।’
লেখকের বক্তব্যের শেষ কথাটিই তাঁর গল্প বা আখ্যান গ্রন্থের চরিত্র। তবে সীমিত বর্ণনার কথা বললেও লেখার বর্ণনাগুলি সুবিস্তৃত। ফিল্মের ভাষায় ডিটেলসে পরিপূর্ণ। লেখক নিজেও চলচ্চিত্রের একজন অনুরাগী এবং চলচ্চিত্র আন্দোলন ও চর্চার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত। ফলে চেতনে অবচেতনে চিত্রকল্প–উপমা–উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রিক একটি প্রভাব দৃশ্যমান তাঁর লেখায়। এ–কারণে লেখাগুলি পড়ার সময় চলচ্চিত্রের দৃশ্য হয়ে তা পাঠকের চোখে ধরা দেয়। এবং এসব গুণ বিচারে প্রতিটি লেখাই আখ্যান না হয়ে নতুন আঙ্গিকের একেকটি গল্পে পরিণত হয়ে উঠেছে।
মোট আটটি ছোটগল্প রয়েছে বইতে; ‘সোনার চেইন, সিনেমা, পল্লী চিকিৎসক, ভিখারি, পানমূল, একটি মোটর গাড়ি, দাঁত ও নীলাভা ক্ষত। বিষয় বৈচিত্র্যে প্রতিটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। প্রতিটি গল্পের আঙ্গিকও স্বতন্ত্র। নির্দিষ্ট কোনো শৈলিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি লেখক। গল্পগুলির পটভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রাম ও চট্টগ্রামের শহর। লেখকের দুই বাসভূমি। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে দিয়ে লেখকের গভীর মনোনিবেশপূর্ণ পর্যবেক্ষণের দিকটি বোঝা যায়।
গল্পগুলি অনেকটা আত্মজৈবনিক। খন রঞ্জন রায়কে যারা ব্যক্তিগতভাবে জানেন, তাদের কাছে বিষয়টি উপলব্ধ হয়, কল্পনার প্রশ্রয় কম। জীবনের অভিজ্ঞতায় সঞ্জাত। ডিটেলসের কথা বলা হয়েছে, কিন্তুু তা যথাযথ পরিমিতবোধের পরিচয় রেখেছে। গল্পের প্রেক্ষাপট বর্ণনার চাইতে ডিটেলস ও পারিপার্শ্বিকতার দিকে লেখকের ঝোঁক বেশি। গল্পের প্লটগুলিও ব্যতিক্রমী এবং মেদহীন; বিশেষ করে মোটর গাড়ি, সিনেমা, দাঁত ও নীলাভা ক্ষত। প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ, প্রবাদ ও অনুষঙ্গ লেখক ব্যবহার করেছেন তার লেখনীতে যা তার লেখাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ–ধরনের প্রয়োগ দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যে লক্ষণীয়। যা বাংলা শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ সংযোজনে ভূমিকা রাখে। খন রঞ্জন রায় এ কাজটি যেমন সচেতনভাবে করেছেন, তেমনি করেছেন গল্পের আবহ ও বিশ্বাসযোগ্যতা নির্মাণের প্রয়োজনে। অধুনা অপ্রচলিত অনেক শ্রুতিমধুর আঞ্চলিক ও প্রমিত শব্দও তিনি প্রয়োগ করেছেন সাবলীলভাবে। তার গদ্য যথেষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত, তবে আরো একটু চাঁছাছোলা হলে ভালো হয়। যেমন গল্পের সংলাপগুলি আরো আটপৌরে হওয়ার দাবি রাখে।
গল্পকার আমাদের সমাজের প্রচলিত শ্রেণি বিভাজনকেও তুলে এনেছেন লেখায়। যেমন দাঁত, ভিখারি ও পল্লী–চিকিৎসক গল্পে যা যথেষ্ট বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য। সমান্তরালভাবে দুই বা ততোধিক সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার চিত্র পাওয়া যায় এসব গল্পে। তবে ‘সিনেমা’ গল্পটিতে দুয়েকটি তথ্যজনক ভুল থাকলেও গল্পের খাতিরে কথকের বয়ানে তা সহজেই মেনে নিতে অসুবিধা হয় না। লেখক তার বন্ধু মহলে এগল্পের আখ্যানটি আড্ডাচ্ছলে অনেকবার বলেছেন আগে। এ গ্রন্থে তার গল্পাবয়ব প্রাপ্তি বেশ চমকপ্রদই বটে !
লেখকের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, তিনি গল্পের কাহিনীটি চিকন বুননে বুনে দিলেও নিজ থেকে সমাপ্তি ও সমাধান টেনে দেন না। এ ভার ছেড়ে দেন পাঠকের হাতে। তবে সুপ্ত বা উহ্য একটা সমাধানের ইঙ্গিত দেন, যার অনুধাবন ও অনুসরণে পাঠক নিজেই সমাপ্তি ও সমাধান রচনা করে নেন। পাঠককেও কল্পনা ও রচনার সুযোগ করে দেন লেখক।
খড়িমাটি প্রকাশন যথেষ্ট মনোযোগ সহযোগে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। কাগজ ও মুদ্রণের মান উন্নত। তবে দুয়েকটা ক্ষেত্রে কি একটু তাড়াহুড়ো ছিল। যেমন কয়েকটি পৃষ্ঠার গেটআপে কিছুটা শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে অনেক। তবে মনিরুল মনিরকৃত প্রচ্ছদ অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী। গ্রন্থের বাঁধাইও খুব সুদৃঢ়, যেদিকে আমাদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে সচরাচর অমনোযোগ ও অযত্ন দেখা যায়। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৫–এর জানুয়ারিতে।
গ্রন্থের প্রথম ফ্ল্যাপে শিল্পরসিক সেলিম শাহ আলম বলেছেন, ‘গল্পের ভেতর আলাদা করে গল্প খুঁজে পাবেন।’ এটাই এই গ্রন্থে সংকলিত গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রন্থের সুচিন্তিত মুখপত্রে কবি হাফজ রশিদ খানের প্রত্যাশা, ‘আশা করি, গল্পগুলো পাঠকের গল্পক্ষুধা মেটাতে সক্ষম হবে–আখ্যানের নতুনত্বে আর প্রাঞ্জল ভাষায় চরিত্র ও আশপাশ চিত্রণের কুশলতায়’। আমরাও কবির প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি করি আন্তরিকতার সঙ্গে।