বেশ ক’বছর ধরে শহরের আবহাওয়া গুমোট। পূর্বে মফস্বলীয় শহরে চাঁদ উঁকি দিতো, বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে বাদাম গুঁড়ো হতো, আম–বট গাছের তলায় জোছনা আলো দিতো, আমাদের আঙ্গিনা ছিল লোকারণ্য। মৃত্যুর প্রয়োজনে আমরা কখনো বেড়ে উঠিনি, আমরা শুধুই রয়ে যেতে চেয়েছি। যে–কোনো মূল্যে। প্রাণ, প্রকৃতির সুর বিনাশ করে শুধুই রয়ে যেতে চেয়েছি। এখন আমাদের শরীরে তীব্র তাপদাহ, এয়ার কন্ডিশন ছাড়া যুৎ নেই। শহরের কোলাহলকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয়, যে গুটিকয়েক খোলা আকাশ আছে, বৃদ্ধ কিছু গাছ আছে তাদের কোলে চড়ে, উচ্চস্বরে হৈ–হুল্লোড় করে জমে শুধু মানুষের ভীড়। দিনে দিনে এসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি, নিত্যনতুন উটকো শব্দ জোড়া হয়েছে কেবল।
পরিবেশের এতো ধ্বনি, সব ধ্বনিতে সাড়া দেওয়া দুষ্কর। তবুও ‘ডাকার মতো যদি ডাক হয়’, ‘প্রাণে যদি প্রাণ মেলে’ তবে সাড়া যে দিতেই হয়। গুমোট ভোরেও কিছু পাখি ডাকে, কিছু পাখি খুঁজে ফিরে শান্তি। আমাদের বিষম মনের কুয়াশা ছাড়িয়ে কেউ কেউ সাড়া দেয়। আমরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে পারি, এ–বেলায় বাজবে ঘন্টা, মজবুত স্বরে আমাদেরও ডাক পড়বে।
গত বছর এমন কাছাকাছি সময় মেলা বসেছিলো। নেত্রকোণার কেন্দুয়ায়, আঙ্গারোয়া গ্রামে এক পরিবারের মাঝে। সুষম যৌথ পরিবার। মেলাকে সফল করতে পরিবারের সকলেই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। আপাতত ইতিহাসে দেশে এমন মেলা প্রথমই বসেছে। খনার মেলা। কিন্তু সুদূর সিংহল রাজকন্যা খনা কিভাবে এলেন এত পথ পাড়ি দিয়ে? তিনিও কি আমাদের কফিল আহমেদ’র প্রাণশক্তির ডাককে উপেক্ষা করতে পারেননি? মঙ্গলঘর পরিসর পরিবার, গ্রাম–বাংলার কৃষক, জনপদের লোক সকলে মিলে উৎসবকে জীবন্ত করেছেন, এগিয়ে দিয়েছেন সুন্দর ভাবনাগুলো।
‘জল ভালা ভাসা, আর মানুষ ভালা চাষা’ খনার এই বচনকে প্রতিপাদ্য ধরে এবার দ্বিতীয়বারের মতো বসেছে খনার মেলা। চৈত্রসংক্রান্তির ভোরের হাওয়ার উদ্বোধনে নববর্ষের প্রথম প্রহর অব্দি সকলে সুরের মোহনায় মিলিত হবেন।
চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৯ টায় ট্রেন ঘোড়ার গতিতে টগবগিয়ে ছুটেছে, যান্ত্রিক কারণে ট্রেন উলটো চলেছে। আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাতে, সোজা পথে কেউ কি আর চলতে চায়? সোজা পথে হেঁটে কতটুকুই আর বাঁচানো যায় প্রকৃতিকে। বাঁকা পথের পথিকেরা ধীরে ধীরে তো সব গিলে ফেলেছে। ভালো–মন্দ রইবার সময় কোথায়। ট্রেন থেমেছে অনেকবার, আমরা নেমেছি গৌরীপুর জংশনে। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ নিজেকে উজাড় করেছে ফলে মিষ্টি বাতাসে বারংবার দোল দিচ্ছে মন। হুমায়ূন আহমেদ তার অনেক লেখায় এই জংশনকে চিনিয়েছেন, আমরা খুব একটা পাত্তা দেওয়ার সময় পাইনি। দ্রুত যেতে হবে আঙ্গারোয়া, অপেক্ষা আর সইছে না। গৌরীপুর থেকে আঙ্গারোয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়/ চেয়ারম্যান বাড়ির পথটা এত বিশাল, ধানের পর ধান ক্ষেত। সেদিনের চাঁদ যেন উঁকি না দিয়ে সম্পূর্ণ মেলে বসেছে। আমরাও আলাপের সুরে বন্ধুত্ব করেছি, কারো কারো চুলে বিনুনি দিয়েছি।
সন্ধ্যার পর শুনশান গ্রাম, দূর হতে শোনা যাচ্ছে ‘আলো হাওয়া বেঁধো না, রোগে ভুগে মরো না’। জোছনা ডুবে আছে পুকুরে, নারিকেল গাছ তার চলন বাঁকিয়ে নিয়েছে, পাশের স্কুল ঘর যেন দূর্গ। জোছনার আলোয় সবকিছুই স্পষ্ট। ফলে চট করে চিনে ফেলা গেলো, এটাই আঙ্গারোয়া, এখানেই হবে খনার মেলা। দ্বিতীয়বারের মতো এই মেলায় কি কি হতে চলেছে, আমাদের কেমনইবা লাগবে? খনাকে তো ভালো করে জানাই হলো না। কিন্তু খনা যেখান থেকেই আসুক, খনা বাংলারও। কর্ণফুলি থেকে নাফ, দিনাজপুর থেকে হাওর সবখানে খনা আছেন।
বদরুদ্দিন চৌধুরী লিপন, কফিল আহমেদ, এবং মঙ্গলঘর পরিসর পরিবারের সকল সদস্যের শুভ আপ্যায়নে রাত পেরিয়ে ভোর হলো, সকাল থেকে মেলার এত তড়িঘড়ি। এতদিনের পরিশ্রম, শেষ মুহুর্তের বাদবাকি কাজ, ভালো হওয়া চাই। ফলে সকলেরই নাভিশ্বাস অবস্থা। মেলার বেষ্টনী অর্ধচাঁদ, সামনে আছে দুটো চাকা, গরুর গাড়ির চাকা এবং লোহার দা–কাস্তে বটিতে দেওয়ার যন্ত্র। সব কিছুর আকৃতি গোলাকার। ফলে কফিল ভাই কড়া সুরে সবকিছুতে একটা সমরূপ দিতে চাইলেন। ঘুড়ি পিছিয়ে গেলো, প্লাস্টিকের চলন তো নিষিদ্ধই, ককশিটও রাখা যাবে না। রঙের ব্যবহারও এবার করা নিষেধ। ফলে চটের কাপড়ে ‘খনার মেলা ১৪৩১’ লিখে সাইজ মোতাবেক নিয়ে কালো আস্তরে সেলাই করে আনা হয়েছে। সম্পূর্ণ সময় কুয়াশা মূর্খ, আরিফুল উদয়, পিয়াসসহ বাকিরা ভীষণ সিলেন্ড্রিকাল প্রেশারে ছিলেন। কীভাবে শেষ হবে সব?
মোটামুটি প্রকৃতির আপন ঢঙ্গে সবকিছু খাপে–খাপে বসতে চলেছে। সকলে মাঝে যেমন গান ধরেছিলো, এখন পুরো দমে মাঝরাত অব্দি চর্চা চালিয়েছে। এর ফাঁকে ধান–বিলের মাঝে ছোট ছোট দলে আড্ডা জমেছে প্রচুর। এভাবেই রাত গেলো, তাঁবু নিয়ে ঘুমিয়েছি আমরা ভোরের শুরুতে।
বিধি মোতাবেক ভোরের হাওয়ায় উদ্বোধন হলো খনার মেলা, গণসংগীতে সকলে গেয়ে উঠলেন ‘খনা আছে জনে জনে, খনা আছে সব জীবনে’। পরিপাটি সকলে বসে পড়েছেন সুসজ্জিত বেঞ্চিতে, ঘুম চোখে পৌঁছে দেখি গানের সুর এতটাই জোরালো ছিল যে প্রকৃতি সাড়া দিয়েছে, প্রাণের ডাকে কালবৈশাখী এসেছে, এই বুঝি সব উড়িয়ে নিবে। ঝড়ো বাতাসে, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই শিল্পীরা উত্তাল সুরে গেয়ে উঠেছেন গঙ্গা বুড়ির গান, ঝড়ের গান, প্রাণ–প্রকৃতির গান। তবে প্রকৃতিকে ভালোবাসার শক্তি এখানে, দ্বিগুন ফিরিয়ে দেয়। খনার মেলার মঞ্চ হয়ে উঠেছে পূর্ণ পৃথিবী, সকলের জমিন। কালবৈশাখী ঝড় যেন খনার মেলাকে আরো জোরদার করেছে।
খনার মেলায় ‘জল ভালা ভাসা, মানুষ ভালা চাষা’ প্রতিপাদ্যে কথা বলবেন গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ। দিনরাত ব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্যে ছিল গান, কবিতা, বাউল গান, কিচ্ছাপালা, গাইন গীত, শ্লোক, খনার কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জীবন আর জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে বিশেষ আলোচনা। মঞ্চে দেখছি শেফালি গায়েন উঠেছেন, খুব আগ্রহ ছিল দেখার। কীভাবে এত উদ্দামশক্তি সঞ্চয় রাখেন তিনি? জানতে হবে। গ্রামবাংলার গাইন গীতের মাধ্যমে লোকজ সংস্কৃতির কিছুটা দেখা হলো। বেশ মজার হলো উনার অভিনয়, বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে নেচে–গেয়ে মুহূর্তের মধ্যে মাতোয়ারা করেছেন দর্শকদের।
এছাড়াও গান করেছেন প্রখ্যাত বাউল সুনীল কর্মকার, প্রবীণ কৃষক বাউল মিয়া হোসেন, কৃষ্ণকলি ও গানের দল, সমগীত, ব্যান্ড সহজিয়া, চিৎকার, মুসা কলিম মুকুল, ফকির সাহেব, কুয়াশা মূর্খ, নূপুর সুলতানা, মঙ্গলঘরের শিল্পী কৃষক দুদু মিয়া, কাঞ্চন পাহাড়ি, দুলাল চিশতি, তরুন শিল্পী ফয়সল, উদয়, সুমন, হৃদয় সহ আরও অনেকে।
চেয়ারম্যান বাড়ি এক সময়ের জমিদার বাড়ি ছিল, গ্রামের মানুষ তাদের বেশ সমাদর করেন। বাড়ির আঙ্গিনার ধারেই ছিল এক পুরান ভাঙ্গা বাড়ি। লিপন ভাই তো মাটির মানুষ, ফলে এই বাড়িকে মাটির কাছেই রেখেছেন। উৎখাতের ভাবনা আসেনি। আমরা তো মাথার উপর ছাদ রাখতেই এত খেটে মরি, ছাদ ছাড়া কিন্তু এই পুরান বাড়ি স্মৃতিতে রয়েছে নিজস্ব গুনে। অপেক্ষা, প্রেম, বায়না, একটু জ্ঞানগর্ব আলোচনা আর ছবির দেশের মতো জড়িয়ে ছিলাম আমরা সেখানে। দুপুরের ভোজে ছিল সাদা ভাত, মাছের ভর্তা, পাঁচ–মিশালি সবজি, মাসকলাইর ডাল, মরিচ ভর্তা। মাটির হাঁড়িতে খাবারের স্বাদ শহুরে হাড়ির চেয়ে ভিন্ন। মেলায় প্রতি বেলায় পাঁচশ মানুষের খাবার চড়ে, আহার করেন সকলে সমভাবে।
খাবারের অপেক্ষায় সে পুরানো বাড়ির পথিকেরা। নদী থেকে পথ, পথ থেকে সুড়ঙ্গ নানাবিধ আলোচনায় পাভেল পার্থ তার প্রাসঙ্গিক আলাপের আসরে একটা জটিল প্রশ্ন করে বসলেন। খনা তো বিস্তরভাবে ছড়িয়েছে, সে ছড়ানো তো এখনকার স্মার্ট ছড়ানো না। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল কিংবা বাংলায় যেভাবে ছড়িয়েছেন খনা সেখানে আদি যুগে যোগাযোগের মাধ্যমটা তবে কি ছিল? কোন টুল ব্যবহার করে খনার বচন ছড়িয়েছে? জানার আছে যেমন, ভাবার জন্যে প্রয়োজন এই সমস্ত যাত্রাকে আমল করা। পাভেল ভাই কিংবা কোনো এক প্রকৃতিপ্রেমি গবেষক নিশ্চয় একদিন আমাদের জানাবেন সে মাধ্যমের কথা।
ভাবছি তবে খনার মেলা কিভাবে ছড়িয়েছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? পত্রিকায়? অনলাইন রেডিও? কি তবে? মানুষের মুখে–মুখে? শহর বৃহত্তর গ্রাম, সেখানে সকল গ্রামীণ মানুষেরই বসাবস। মানুষ জমিয়ে সেখানে বিশাল এক তাপানুকূল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছেন অনেকে, বহু সময় ধরে। কিন্তু তাদের সকলের প্রশ্বাস এতটাই ভারি যে, প্রকৃতির মুক্ত বাতাস ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। গ্রাম থেকে জোরপূর্বক ধরে আনা গরুর গাড়ি, চাকা, কাঁথা, নারিকেলের খোলস কিংবা বাউল–বয়াতি, যাই হোক না কেন তা সবই মেকি, বানোয়াট। সহজাত সুন্দরকে নষ্ট করে, অতিরঞ্জিত স্বাদ মুখকে বিষিয়ে তোলে। বিষ দিয়ে বিষ তোলা যায়। এবার কফিল ভাই সকল শহুরে মানুষকেও আমন্ত্রণ জানালেন আঙ্গারোয়ার আসরে। এখানেই আসতে হবে তোমাকে, শেকড় তোমার কাছে যাবে না বরং তুমিই শেকড়ের কাছে আসো। চিড়িয়ার অন্যপক্ষে এবার তুমি দাঁড়াও, ডুগডুগি বাজাও বাজাও…।
‘সব ছাড়ে মন তোমায় ছাড়ে না, সব ছাড়ে মন লোভ ছাড়ে না’। কৃষ্ণকলি গাইলেন। ভাবছি শহুরের কুলষিত মন এখানেও হানা দিতে পারে, নষ্ট করতে পারে এর আবহ। তবে এত মানুষ মিলে একসাথে এভাবে ভাল সময় বোধহয় আগে কাটেনি, নির্ঘুম দিন–রাত এত সুন্দর হতে পারে ভাবিনি। নিশিত–খাবার শেষে আমরা আবারো মঞ্চের সামনে। দিনের শ্রমিকেরা, কৃষকেরা যারা খেটেছেন এতকাল, রাত বাড়তে আনাগোনা শুরু হয়েছে তাদের। জমজমাট মানুষ, গানের পর গান। ঠিক এ–সময় আমাদের ঘুমের লোভ বলতে আর কিছুই রইলো না, আমরা হেঁটে–বসে গান শুনছি শুধু।
মেলা বসেছে, বিকিকিনি হচ্ছে। রাতও বাড়ছে। মধ্যরাত এখন, কফিল ভাই মঞ্চে এলেন। তার বিশাল বহর, সুরের কম্পনে সম্পূর্ণ শরীরকে ঝাঁঝালো শক্তিতে পাখা ঝাপটিয়ে শোনালেন এক দার্শনিক কৃষকের গান আর আমাদের বৈশ্বয়িক দর্শনের বৈকল্যতার কথা। জানালানে, প্রকৃতি মানেই মাথা নত না করা। মাসানোবোফুকোওকা!
এরপর খনার জবান কীভাবে ছড়িয়েছে? খনার মেলা থেকে আমাদের কি আর আসা হয়েছিলো? আসা–যাওয়ার এই যাত্রাটাই ফলে ভালো লেগেছে, খনার জবান নিয়ে এমন মেলার জন্যে আরেকটা পলক, আরেকটা যাত্রা দেওয়াই যায়।