খতিব ইমাম মুয়াজ্জিনদের আর্থিক দৈন্য ঘুচাতে হবে

আ ব ম খোরশিদ আলম খান | সোমবার , ৬ জুন, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

ঘুরে ফিরে চব্বিশ ঘণ্টাই চাকরি করতে হয় মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন সাহেবদেরকে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই চব্বিশ কর্মঘণ্টার চাকরির দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানোর জন্য কয়েক ঘণ্টা পর পর দায়িত্ব পালন করতে হয় মসজিদের ইমামদেরকে। মুয়াজ্জিনরা নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন পাঁচবার আজান দেন। এমন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সময়ানুবর্তিতা মেনে চব্বিশ ঘণ্টার চাকরি করা সত্ত্বেও প্রতিদান বা বিনিময় হিসেবে ইমাম মুয়াজ্জিন সাহেবরা কতো টাকা বেতন ভাতা পাচ্ছেন তা আমরা খেয়াল করে দেখছি কি? তাঁদেরকে যে বেতন বা মাসিক সম্মানী দেওয়া হয় তাতে তাঁদের প্রয়োজন কতোটা মিটছে? তাঁরা কি জীবন ধারণ উপযোগী উপযুক্ত বেতন ভাতা পাচ্ছেন? এক কথায় বলা যায়-‘না’।

গ্রামের কথা বাদই দিলাম। গ্রামের মসজিদে আয় ইনকামের সুযোগ তেমন থাকে না। মসজিদের মহল্লাবাসীর দেয়া আর্থিক অনুদান চাঁদায় খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মাসিক বেতন-সম্মানী দেওয়া হয়। কিন্তু শহরের মসজিদগুলোর নব্বই ভাগই চলে মসজিদের মার্কেট বা দোকানের আয় দিয়ে। প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয় মসজিদ মার্কেটের দোকান ভাড়া থেকে। তবুও কেন খতিব ইমাম মুয়াজ্জিনদের নামে মাত্র ১০/১২/১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয় তা আমাদের বুঝে আসে না। এই সামান্য বেতনে তাঁদের সংসার পরিবার চলে কী করে তা কি আমরা ভেবে দেখি? পরিবারে মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ পোষণ কি এই সামান্য বেতন দিয়ে নির্বাহ করা যায়? বছর বছর যুগ যুগ ধরে খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেমদের প্রতি এই অবিচার চলে এলেও আমাদের কারো হুঁশ হয় না। তাঁদের প্রতি আমাদের দরদ ও দায়িত্বানুভূতি কেন জাগে না?

এই লেখা রচনার আগে গ্রামের-শহরের প্রায় বিশ-পঁচিশটি মসজিদের খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের অভাব অভিযোগ দুঃখ কষ্টের কথা উপলব্ধির চেষ্টা করেছি। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি তাঁদের আর্থিক দৈন্য দশার বিষয়টি। তাঁদের চোখে মুখে হাসি নেই। মলিন বিষণ্ন চেহারা। ভেতরে ভেতরে তাঁরা পুষছেন ক্ষোভ-যন্ত্রণা। কিন্তু নিজেদের দুঃখ-বঞ্চনা-অভাব-অপ্রাপ্তির কথা কাউকে শোনাবেন এমন দরদী মানুষও তাঁরা খুব একটা খুঁজে পান না। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা মসজিদের নামাজের দায়িত্বে তাঁরা নিজেদের সঁপে দেন-তবুও মাস শেষে তাঁরা যে সামান্য বেতন-সম্মানী পান তাতে তাঁদের জীবনতরী যেন কিছুতেই চলে না। অভাব দুঃখ-দুর্দশাই যেন তাঁদের নিত্য সঙ্গী। অভাব যেন তাঁদের পিছু ছাড়ে না। তাহলে এই বৈষম্য-বঞ্চনা কি যুগ যুগ ধরে প্রতিকারবিহীনভাবে চলতেই থাকবে?

গ্রামের মসজিদগুলোতে ইমাম-মুয়াজ্জিন মাত্র দুজনই থাকেন। মসজিদ খুব বড় বা বিখ্যাত না হলে খতিব ছাড়াই চলে মসজিদ। ইমাম সাহেবই জুমা পড়ান। আর যদি খতিব থাকেনও মাসে তাঁর সম্মানী দেওয়া হয় চার/পাঁচ/ছয় বা আট হাজার টাকা। সাধারণত, ইমাম সাহেবকে দেওয়া হয় চার-পাঁচ-সাত-আট হাজার টাকা মাসিক সম্মানী। মুয়াজ্জিন সাহেবদের অবস্থা আরো শোচনীয়। তাঁদের সর্বোচ্চ বেতন চার পাঁচ ছয় হাজার টাকার চেয়ে বেশি নয়। দিনে রাতে তাঁরা মসজিদ পাহারা দেন, থেমে থেমে পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেন। মসজিদের নামাজের দায়িত্ব পালনে তাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিলেও বিনিময়ে তাঁরা কী পাচ্ছেন? সামান্য বেতনে তাঁরা কীভাবে সংসার-পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকবেন তা বহু মসজিদ কর্তৃপক্ষ খুব দরদী মন দিয়ে ভেবে দেখেন না। অথচ ইচ্ছা করলে বা একটু মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করে খতিব-ইমাম- মুয়াজ্জিনদের বেতন ভাতা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়ানো যায়। দরকার একটু সদিচ্ছা ও উদ্যোগ। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে মসজিদের খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেমদের জীবনতরী আর চলছে না। তাঁরা না পারছেন পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে, আর না পারছেন চাকরি ছাড়তে। আর্থিক দৈন্য নিয়ে গভীর হতাশায় তাঁরা দিন পার করতে বাধ্য হচ্ছেন। জীবনযুদ্ধে তাঁরা হেরে যাচ্ছেন। তবুও মসজিদ কর্তৃপক্ষ বা সমাজ তাঁদের প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ- এটাই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।

গ্রামের মসজিদগুলোর কথা তো বলা হলো। শহরের মসজিদগুলোর নব্বই ভাগের যথেষ্ট আয় ইনকামের কথা আমরা জানি। প্রায় প্রতিটি মসজিদ স্থাপনার সঙ্গে থাকে মার্কেট-দোকান। যা থেকে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয়। তবুও কেন খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিনদেরকে আট/দশ/বারো হাজার টাকার মতো নামে মাত্র বেতন-সম্মানী দেওয়া হয় তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। মসজিদের আয়ের সিংহভাগ তো তাঁদের জন্য খরচ করাই যৌক্তিক ও সঙ্গত। মসজিদের উন্নয়নের জন্য তো নিয়মিত চাঁদা/অনুদান তোলা হয়। তা উন্নয়ন কাজের জন্য খরচ করা যায়। মসজিদের অন্যান্য আয়ও এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়। মসজিদের সমুদয় আয়ের বড় অংশ খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেমদের জন্য ব্যয় করাটাই হচ্ছে যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত। তাঁদেরকে আর্থিকভাবে দৈন্য-দুর্দশার মধ্যে রেখে কিংবা জীবন ধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না দিয়ে আমরা যে কতটা অমানবিকতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি তা কি কখনো ভেবে দেখছি? তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা নেই। ২০/৩০ বছর ধরে একটানা মসজিদের চাকরি করেও তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হয়। নেই প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন বা অবসর সুবিধা। মসজিদ কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিতে এক ঘণ্টার মৌখিক নোটিশে তাঁদের চাকরি হারাতে হয়। কী অমানবিকতা চলছে বছর বছর ধরে!

মসজিদ কমিটির যাঁরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ আছেন তাঁদের অনেকেরই তো বিত্ত বৈভব ধন সম্পদের অভাব নেই। এমনও দেখা যায়, তাঁরা নিজেদের জন্য প্রতি মাসে লাখ-দুই লাখ টাকাও খরচ করেন। তাঁদের আয়ের বহুমুখী পথ খোলা। তাঁরা যদি মাসে লাখ-দুই-তিন লাখ টাকা পরিবার পরিজনের জন্য দুই হাতে খরচ করে থাকেন, তাহলে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা ১০/১২ হাজার টাকার সামান্য স্বল্প বেতনে কীভাবে দিন যাপন করেন- এই জিজ্ঞাসা তো তাঁদের কাছে করাই যায়? তাঁরা কেন দরদী ও মানবিক আচরণ করবেন না! মহান আল্লাহ পাকের দরবারে এজন্য কি তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে না? অথচ অধীনস্থ ব্যক্তিদের প্রতি মানবিক আচরণ করা এবং জীবন ধারণ উপযোগী বেতন ভাতা দেয়াই তো ইসলামের শাশ্বত নির্দেশনা। কেউ ধন ঐশ্বর্যে ডুবে থাকবে, আর অন্যরা দুই বেলা খাওয়া পরার বা দিন যাপনের ভরসাটুকুও পাবে না তা তো অবশ্যই অবিচার, নিষ্ঠুরতা ও জুলুম।

শহর-গ্রামের মসজিদগুলোর সম্মানিত কর্তৃপক্ষ বা পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে বিনীতভাবে বলবো- আপনারা যাঁদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নামাজ কালামের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিচ্ছেন, আল্লাহ-রাসূলের (দ.) নৈকট্য অর্জন করছেন, ইবাদত বন্দেগিতে নিজেদের সঁপে দিচ্ছেন, আপনাদের ইবাদত-আরাধনা সার্থক করে তুলতে খতিব-ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবদের প্রতিও মানবিক ও দরদী হোন। তাঁদের মুখে হাসি ফোটানো আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব। আপনাদের একটু উদ্যোগ ও সদিচ্ছায় তাঁরাও সচ্ছল জীবন যাপনে সক্ষম হতে পারে। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে যাঁরা আপনাদেরকে আল্লাহর দরবারে সোপর্দ করছেন তাঁদের প্রতি কেন দরদী ও মানবিক হবেন না? তাঁদের আর্থিক দৈন্য ও দুঃখ-দুর্দশা মোচন করুন। বর্তমান অযৌক্তিক অমানবিক বেতন কাঠামোর ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা করুন। তাঁদেরকেও পরিবার পরিজন নিয়ে সচ্ছলতার সঙ্গে চলার সুযোগটুকু করে দিন। মসজিদের আয়ের বড় অংশ তাঁদের জন্য ব্যয় করুন। এটাই সময়ের দাবি। ঈমানি দায়িত্ব এবং মানবতার দাবি।

লেখক : সাংবাদিক, নির্বাহী পরিচালক : ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারিবারিক শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস