মশার কামড়ে কাতিব রাতে ঘুমাতে পারছে না। দরজার বাইরে সে একটা জ্বলজ্বল আলো দেখতে পেল। দরজা খুলে আকাশের দিকে তাকালো। কালো রঙে পরিণত হওয়া আকাশটা একটানা ফিউজ টিউবলাইটের মতো জ্বলছে। মেঘের গর্জন ড্রামের মতো দূর থেকে শোনা যাচ্ছে। যেন বর্ষার আগমনকে স্বাগত জানাতে বাজানো হচ্ছে অনবরত। ভেতরে ফিরে এসে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল কাতিব। কিছুক্ষণ পর সে ঘুমিয়েও পড়ল।
সকাল হলেই বৃষ্টির শব্দে চোখ আপনা-আপনি খুলে গেল। দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল। জলের ঢেউয়ে বৃষ্টির ফোঁটা দুলছে। সে উপরওয়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করল। মনে মনে বিড়বিড় করল, আল্লাহ যেন পৃথিবীর তৃষ্ণা আর কৃষকের আশা মেটান।
ভিজতে-ভিজতে প্রতিদিনের রুটিন সেরে উঠানে রাখা ভোজ্য তেলের বড় বাক্সে পানি ভর্তি করে গোসল সেরে নিল। সে প্রস্তুত হয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগল। প্রাায় তিন ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামলে তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল।
বড় হলঘরে তৈরি রান্নাঘরে কোনো নাড়াচাড়া দেখতে পেল না কাতিব। অসহায়দের জন্য তৈরি খাবারের প্যাকেটে সাহায্যকারী স্বেচ্ছাসেবকদেরও দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ অন্যলোকের অপেক্ষায় বসে থাকল। একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে জানালো, বৃষ্টির কারণে প্যাকেট তৈরির কাজ বন্ধ রয়েছে।
কাতিব হতবাক হয়ে গেল। সে বলল, তাহলে আজ কি সবাইকে ক্ষুধার্ত থাকতে হবে?
স্বেচ্ছাসেবক বলল, পুরো রান্নাঘরটি বিশৃঙ্খল, রাস্তায় বন্যা, তাই অভাবীদের কাছে প্যাকেটগুলো পৌঁছে দেওয়া কঠিন।
স্বেচ্ছাসেবকের কথা শুনে প্রথমে হতাশ হয়ে গেল কাতিব। তারপর কিছু ভেবে বলল, আমাদের সঙ্গ দিলে কিছু প্যাকেট করা যায়, কত লোক খাওয়ার আশায় রাস্তায় হাঁটছে।
স্বেচ্ছাসেবকটি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল। রান্নাঘরের দরজা খুলে বলল, ঠিক আছে, চেষ্টা করি।
দু’জনেই খাবার তৈরি করতে লাগলো।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো পারিশ্রমিক বা মজুরি ছাড়াই শত শত মানুষের খাবার রান্না করে আসছে কাতিব। বিনিময়ে সেও পেট ভরে খেতে পায়। দাতাদের সহযোগিতায় এবং স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের উৎসাহে দুপুর নাগাদ খাবারের প্যাকেট প্রস্তুত হয়ে যায়। তারপর স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের গাড়িতে রেখে অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে আজ খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। যদি কাতিব চেষ্টা না করে এবং একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক রাজি না হয়, তাহলে অনেক অসহায় মানুষকে অভুক্ত থাকতে হবে। অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপস্থিতির কারণে, খাবারটি কম পরিমাণে এবং দেরিতে প্রস্তুত হলো, তবে অবশেষে বিতরণের জন্য প্রচুর প্যাকেট প্রস্তুত হয়ে যায়।
কাতিব নিজেই স্বেচ্ছাসেবকের সাথে প্রথমবারের মতো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করতে বেরিয়েছে। অনেক অসহায়, ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে বসে আছে আসার পথের দিকে। খাবারের প্যাকেটটা হাতে পেয়েই তার চোখ তৃপ্ত হয়ে উঠতে লাগল। কাতিব স্বেচ্ছাসেবকের সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবারের প্যাকেট বিতরণ করতে থাকল, কিন্তু এর মধ্যে সকাল থেকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় একবারও খেতে পারেনি সে। খাবারের প্যাকেট কম হওয়ায় সবার কাছে পৌঁছাতে না পারায় কাতিব খুবই মর্মাহত। তারা সব প্যাকেট বিতরণ করেছে। ফিরে এসে থালা-বাসন ধোয়ার আগে দেখল পাতিলের তলায় কিছু খাবারের দানা আটকে আছে। সেই দানা কয়েকটি তার জিভের উপর রাখল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরে কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়ল। সে খুব স্বস্তিবোধ করছে। শুয়ে পড়তেই চোখ বন্ধ করল, হঠাৎ কিছু পরিবর্তন অনুভব করল। রাতে মশার গুণগুণ আর ক্ষুধা টের পেল না।
বৃষ্টি হলেই মশা আক্রমণ করে, কিন্তু হঠাৎ করেই আজ রাতে তার বাড়ি থেকে মশা উধাও হয়ে যায়। মনে মনে বিড়বিড় করে কাতিব বললো, মনে হয় আজ মশাও রোজা রেখেছে।
মাঝরাতে আকাশে নক্ষত্রের অস্তিত্ব অনুভব করল। আস্তে আস্তে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল কাতিব।